প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৬ নভেম্বর, ২০২৫
ন্যায়বিচারের ধারণা আমাদের সমাজের মূলভিত্তি। প্রতিটি ব্যক্তি আশা করে, তার অধিকার রক্ষা হবে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিচার করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেকেই ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে- বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি মিথ্যা মামলা, দুর্নীতি, অসচেতনতা বা প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে ঘটে। আমাদের দেশে আইনি ব্যবস্থার কিছু ফাঁকফোকর অপরাধীদের সুযোগ দেয়, আর নির্দোষ মানুষদের জীবন নষ্ট হয়।
মিথ্যা মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ব্যবসায়িক লেনদেন, পারিবারিক বিবাদ বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে প্রায়শই কেউ কাউকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে। অপরাধী নয়, এমন মানুষদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনাও কম নয়। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং অপর্যাপ্ত আইনি সচেতনতা মানুষকে বিপন্ন করে। অনেক নির্দোষ মানুষ আদালতের জটিলতা, খরচ ও সময়ের কারণে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না।
সামাজিক রীতিনীতি এবং লোভ-বিদ্বেষও ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করে। কখনও কখনও ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা প্রভাবশালী গোষ্ঠী নির্দোষ মানুষকে অন্যায়ভাবে ফাঁসাতে সক্ষম হয়।
এই ফাঁকফোকরগুলো সমাজে অসাম্য, ভয় এবং অন্যায়ের প্রবণতা বাড়ায়। তাই সচেতনতা, আইনি শিক্ষা এবং প্রশাসনিক শক্তি বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি, যাতে ন্যায়বিচার সবার জন্য সমানভাবে নিশ্চিত হয়। একটি সাম্প্রতিক অনলাইন জরিপে ১,৫০০ জন অংশগ্রহণ করেন, যেখানে মিথ্যা মামলার কারণে ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সমাজে মিথ্যা মামলা অনেকের জীবন ও পরিবারের জন্য ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে। প্রায় ৬২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেন, তারা বা তাদের পরিচিত কেউ কখনও মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছে অথবা এর ভয় ভোগ করেছে। ৫৫ শতাংশ মানুষ মন্তব্য করেছেন, দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক জটিলতা এবং আইনি সচেতনতার অভাবের কারণে নির্দোষ মানুষরা সহজেই ফাঁসানো হয়।
জরিপে আরও দেখা যায়, ৬৮ শতাংশ উত্তরদাতা বিশ্বাস করেন, সামাজিক দ্বেষ, ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রভাব এবং লোভের কারণে ন্যায়বিচারকে বিকৃত করা হচ্ছে। ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক শক্তি বাড়ানো এবং আইনি জ্ঞান ছড়ানো জরুরি। জরিপের ফলাফল স্পষ্ট করে দেয়- মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া এখন শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, সমাজের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার মূল কারণগুলো সমাজের গভীর সমস্যা ও ফাঁকফোকরের সঙ্গে জড়িত। প্রথমত, ব্যক্তিগত দ্বেষ ও স্বার্থপরতা। অনেক সময় ব্যবসায়িক লেনদেন, পারিবারিক বিরোধ বা প্রতিযোগিতার কারণে কেউ কাউকে ফাঁসানোর জন্য মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে। স্বার্থ হাসিলের জন্য সত্যকে বিকৃত করা সমাজে একটি সাধারণ প্রবণতা হয়ে উঠেছে। আইনি ও প্রশাসনিক দুর্বলতা। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা, আদালতের জটিলতা, খরচ এবং সময়ের অভাব মানুষকে নিজেকে রক্ষা করতে বাধ্য করে না। অপরাধী বা ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রভাবও বিচারকে প্রভাবিত করতে পারে, যা নির্দোষ মানুষকে ফাঁসাতে সহায়ক হয়।
সামাজিক ও মানসিক ফ্যাক্টর। প্রতারণা, অহংকার, লোভ এবং সামাজিক দ্বেষ ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি করে। কিছু ক্ষেত্রে সমাজের মধ্যস্থতাকারীরা পক্ষপাতিত্ব দেখায়, যার ফলে নির্দোষ মানুষ আইনের আওতায় সঠিকভাবে রক্ষা পায় না। আইনি জ্ঞানের অভাব। অনেক মানুষ তাদের অধিকার ও প্রতিকার জানে না, ফলে তাদের সহজেই ফাঁসানো হয়। ব্যক্তিগত স্বার্থ, প্রশাসনিক দুর্বলতা, সামাজিক দ্বেষ ও আইনি অজ্ঞতা মিথ্যা মামলার শিকার হওয়ার প্রধান কারণ। মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া এবং ন্যায়বিচার বঞ্চিত হওয়ার সমস্যার সমাধান অনেক দিক থেকে করা সম্ভব। প্রথমত, আইনি সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার, আইনের প্রক্রিয়া এবং প্রতিকার সম্পর্কে জানাতে হবে। এর মাধ্যমে নির্দোষ ব্যক্তি সহজেই ফাঁসানো থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আদালতের দীর্ঘসূত্রিতা, জটিলতা এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তির প্রভাব হ্রাস করতে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি এবং বিচারের মান নিয়ন্ত্রণ এ ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। সচেতন সমাজ গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষকে নৈতিকতা, সততা এবং মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব বোঝাতে হবে। সামাজিক সংহতি ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পেলে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার প্রবণতা কমবে।
আইনি সহায়তা ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা সহজলভ্য করা উচিত। নির্দোষ মানুষ যাতে আইনজীবী ও সমর্থন পায়, তা নিশ্চিত করলে তারা আত্মরক্ষায় সক্ষম হবে। সব মিলিয়ে, আইনি সচেতনতা, প্রশাসনিক দক্ষতা, সামাজিক নৈতিকতা এবং সহায়তা ব্যবস্থা মিলিয়ে মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর ফলে সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয় এবং নির্দোষ মানুষদের অধিকার রক্ষা করা যায়।
মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া সমাজের জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়। আমার মতামত হলো, এটি শুধু নির্দোষ ব্যক্তির সমস্যা নয়, পুরো সমাজের নৈতিক ও আইনি ব্যবস্থার একটি প্রতিফলন। আমাদের সমাজে নৈতিকতা, সততা এবং মানবিক মূল্যবোধের গুরুত্ব এখন হ্রাস পাচ্ছে, যা মিথ্যা অভিযোগের প্রবণতাকে উস্কে দিচ্ছে।
ব্যক্তি ও পরিবারিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। মানুষকে শিখতে হবে, সত্য এবং ন্যায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া সামাজিক শান্তি ও সাম্য নিশ্চিত করে। দ্বিতীয়ত, আইনি জ্ঞানের প্রসার অপরিহার্য। অধিকাংশ মানুষ তাদের অধিকার, আইনের খুঁটিনাটি ও প্রতিকার প্রক্রিয়া জানে না, যা তাদের ফাঁসানোর ঝুঁকি বাড়ায়। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। বিচার প্রক্রিয়ার জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা নির্দোষ মানুষদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। শক্তিশালী এবং স্বচ্ছ প্রশাসন মিথ্যা অভিযোগের প্রভাব কমাতে পারে।
সচেতনতা, শিক্ষা এবং নৈতিকতা রক্ষা করলেই আমরা মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া প্রতিরোধ করতে পারি। এটি শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজকে নিরাপদ ও ন্যায়সঙ্গত রাখার পথ। মিথ্যা মামলার শিকার হওয়া শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সমস্যাই নয়, সমাজের নৈতিক ও আইনি দুর্বলতার প্রতিফলন। এটি প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন আইনি সচেতনতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, সামাজিক নৈতিকতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা। নির্দোষ মানুষ যাতে দ্রুত ও সঠিক ন্যায় পায়, তা নিশ্চিত করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্র মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সচেতনতা এবং শক্তিশালী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মিথ্যা মামলার প্রভাব কমানো সম্ভব। ফলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে, নির্দোষ মানুষের অধিকার রক্ষা পাবে এবং মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি দৃঢ় হবে।