প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দক্ষিণের আঁকাণ্ডবাঁকা তটরেখা আমাদের চোখে পড়ে। এই তটরেখা উপকূলে বসবাস করা কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার আধার। কিন্তু প্রকৃতির রুদ্ররোষে এই জনপদ এখন বিপন্ন। উপকূলীয় মানুষ অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি। তাদের পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। নদী গিলে খাচ্ছে তাদের শেষ সম্বল। নোনা জল গ্রাস করছে ফসলি জমি। বাধ্য হয়ে মানুষ ছাড়ছে বাপ-দাদার ভিটে। বড় হচ্ছে জলবায়ুু শরণার্থীর মিছিল।
সাতক্ষীরা বা খুলনার প্রত্যন্ত কোনো গ্রামে গেলে বাতাসের সঙ্গে মিশে থাকা নোনা স্বাদ পাওয়া যায়। একসময় যেখানে ধানের শীষে বাতাস দোল খেত, সেখানে এখন মাইলের পর মাইল নোনা পানির চিংড়ি ঘের। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মনে হতে পারে। কিন্তু এর পেছনের গল্পটা করুণ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। জোয়ারের পানি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চতায় লোকালয়ে প্রবেশ করে। বাঁধ ভেঙে নোনা পানি ঢুকে পড়ে গ্রামে। সেই পানি আর সহজে নামে না। ফলে মিষ্টি পানির আধারগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কৃষিজমি চাষাবাদের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে। একজন কৃষক যখন দেখেন তার জমিতে আর সোনালি ধান ফলবে না, তখন তার সামনে পথ খোলা থাকে দুটি। এক হলো অনাহারে মৃত্যু, আর দুই হলো জীবিকার সন্ধানে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমানো। অধিকাংশ মানুষ দ্বিতীয় পথটি বেছে নেয়। তারা হয়ে ওঠে জলবায়ু শরণার্থী।
প্রকৃতির এই পরিবর্তন একদিনে হয়নি। বছরের পর বছর ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফল ভোগ করছে বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষ। সিডর, আইলা বা আম্পানের মতো ঘূর্ণিঝড়গুলো উপকূলের মানুষের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের পর হয়তো সরকারি বা বেসরকারি সাহায্য আসে। কিছু চাল বা ডাল পাওয়া যায়। কিন্তু ভেঙে যাওয়া বাঁধ আর সহজে মেরামত হয় না। নোনা পানি একবার ঢুকলে সেই জমিতে আগামী কয়েক বছর ফসল হয় না। এই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা একজন সাধারণ জেলের বা কৃষকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই তারা বাধ্য হয়ে শহরের দিকে ছোটেন।
শহরের বস্তিতে ঠাঁই নেওয়া এই মানুষগুলোর জীবনের গল্প আরও মর্মান্তিক। খুলনার দাকোপ বা সাতক্ষীরার শ্যামনগর থেকে আসা একজন মানুষ আত্মসম্মান ও সামাজিক পরিচয়ের তোয়াক্কা না করে আশ্রয় নেন ঢাকার বস্তিতে। গ্রামে হয়তো তার নিজস্ব এক টুকরো জমি ছিল। পুকুর ভরা মাছ ছিল। কিন্তু শহরে তিনি হয়ে যান শুধুই একজন দিনমজুর বা রিকশাচালক। তার স্ত্রী হয়তো অন্যের বাড়িতে কাজ নেন। যে শিশুরা গ্রামে মুক্ত বাতাসে বেড়ে উঠছিল, তারা বন্দি হয়ে পড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর অর্থনৈতিক সমস্যার পাশাপাশি তৈরি করে গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট।
আমরা প্রায়ই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলি। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বড় বড় বুলি আওড়ানো হয়। কিন্তু উপকূলের এই মানুষগুলোর কান্না সেই সম্মেলন কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে। এই সংখ্যাটি আঁতকে ওঠার মতো। একটি দেশের মোট জনসংখ্যার এত বড় অংশ যদি স্থানচ্যুত হয় তবে তার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতির ওপর। ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো শহরগুলো এখনই ব্যাপক জনাকীর্ণ। এরপর আরও কোটি মানুষের চাপ সামলানোর সক্ষমতা এই শহরগুলোর নেই।
প্রশ্ন হলো এই মানুষগুলো কেন পালাচ্ছে? তারা পালাচ্ছে কারণ তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। নদীভাঙন উপকূলের মানুষের কাছে এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ভোলা বা হাতিয়ার মতো দ্বীপগুলোতে প্রতি বছর হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীতে বিলীন হচ্ছে। আজ যার গোয়াল ভরা গরু আর গোলা ভরা ধান আছে, কাল সকালে সে তার সবই হারাতে পারে। এই অনিশ্চয়তাই মানুষকে যাযাবর বানিয়ে দিচ্ছে। তারা জানে না আগামীকাল তাদের মাথার ওপর ছাদ থাকবে কি না। এই মানসিক চাপ আর ভয় তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের এক নিষ্পাপ শিকার। কার্বন নিঃসরণে আমাদের ভূমিকা নগণ্য হলেও এর দায় আমাদের মেটাতে হচ্ছে চড়া দামে। উন্নত দেশগুলো তাদের শিল্পায়ন চালিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের বিলাসী জীবনের খেসারত দিচ্ছে আমাদের উপকূলের জেলেরা ও বাওয়ালিরা। এটি এক চরম অবিচার। জলবায়ু তহবিল থেকে যে সাহায্য আসার কথা তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। আবার সেই তহবিলের সঠিক ব্যবহার নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। কেবল বাঁধ নির্মাণ করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। প্রয়োজন টেকসই পরিকল্পনা।
উপকূলীয় বনায়ন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিকভাবে রক্ষা করে আসছে। কিন্তু মানুষের লোভের কারণে সুন্দরবনও আজ হুমকির মুখে। সুন্দরবন ধ্বংস হলে উপকূলীয় জেলাগুলো সাগরের গ্রাসে চলে যাবে। তখন শরণার্থী সমস্যা যে পর্যায়ে পৌঁছাবে তা সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। এছাড়া লবণাক্ততাসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন ও চাষাবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য বড় বড় আধার তৈরি করতে হবে, যাতে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির অভাব না হয়।
তবে কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নই যথেষ্ট নয়। মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় যদি বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা যায় তবে মানুষ আর শহরমুখী হবে না। কুটির শিল্প এবং হাঁস-মুরগি পালনের মতো ছোট ছোট উদ্যোগগুলোকে বড় পরিসরে সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। মানুষকে বোঝাতে হবে যে তাদের মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার সুযোগ আছে। রাষ্ট্র যদি তাদের পাশে দাঁড়ায় তবে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
বাস্তবতা হলো জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়। এটি আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। বরগুনা বা পটুয়াখালীর কোনো এক গ্রামের বৃদ্ধ যখন ছলছল চোখে তার ভেঙে যাওয়া ভিটার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তখন আমরা বুঝতে পারি এই সংকট কতটা গভীর। তিনি জানেন এই মাটিতে তার পূর্বপুরুষরা ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু তিনি জানেন না তার সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে। এই শেকড়হীন মানুষের হাহাকার আমাদের বিবেককে নাড়া দেওয়া উচিত। আমরা যদি এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিই তবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ এক বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে।