প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০২ ডিসেম্বর, ২০২৫
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে কিছু বিষয় অভ্যাসের মতো মেনে আসছি। যার মধ্যে অন্যতম হলো ক্লাসে শিক্ষকদের দেরি করে আসা, নির্ধারিত সময়ের পরও লেকচার চালিয়ে যাওয়া এবং সময় মতো উপস্থিত না থেকেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিয়ে কঠোরতা দেখানো। এগুলো শুধু শৃঙ্খলার অভাবেরই পরিচয় দেয় না, বরং গভীরভাবে শিক্ষাগত বৈষম্যের দিকেও ইঙ্গিতও দেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতর যে নৈতিকতা, যে সময়শৃঙ্খলা এবং যে দায়বদ্ধতার প্রয়োজন, তার সবচেয়ে বড় রূপক তো আসলে শিক্ষকই। কিন্তু যখন সেই শিক্ষকই সময়কে অবহেলা করেন, তখন শিক্ষা তার মৌলিক চরিত্রেই ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ক্লাসে দেরি করে এলে, সেটা হয়তো তার কাছে খুবই ছোট বিষয়। ১০ বা ১৫ মিনিটের বিলম্ব তার কাছে বিশেষ কিছু না। কিন্তু এই সময়টাই শিক্ষার্থীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু ক্লাস করতে আসেন না, তাদের সমান গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কাজও থাকে যেমন অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন তৈরি করা, গ্রুপওয়ার্ক, পার্ট-টাইম জব, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, গবেষণা, এমনকি অনেকে পরিবারের দায়িত্বও পালন করেন।
তারপরও অনেক শিক্ষক ২০-৩০ মিনিট দেরি করে এসে আবার সেই হারানো সময়টুকু পুষিয়ে দেওয়ার নামে সময় শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘ লেকচার চালিয়ে যান। এখানে প্রশ্ন হলো এই অতিরিক্ত সময়টি কার সময়? এই সময় কি শিক্ষক নিজের জীবন থেকে দিচ্ছেন, নাকি ছাত্রের সময় কেড়ে নিচ্ছেন? একজন শিক্ষক যখন ক্লাস শেষ হওয়ার পরে আরও ৩০ মিনিট লেকচার চালান, এটা শিক্ষার নাম করে অন্যের সময় লুট করা ছাড়া আর কী?
বৈপরীত্যের সবচেয়ে বড় জায়গা হলো একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে ৫ মিনিট দেরি করলে অ্যাটেনডেন্স পান না, তাকে ‘শৃঙ্খলা’ শেখানো হয়। কিন্তু সেই একই শিক্ষক যদি ২০ মিনিট দেরি করে আসেন তখন সেটাকে আমরা ‘ব্যস্ততা’, ‘পরিস্থিতি’, বা ‘অন্য ক্লাসে ছিলেন’ বলে মানিয়ে নিই। এই মানদ- কি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ন্যায়ের পথে নিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়? তারপর, ধরুন একজন শিক্ষক ৩০ মিনিট দেরি করলেন এবং আবার সময় শেষে আরও ৩০ মিনিট লেকচার চালালেন। যেটা মোট ৬০ মিনিটের অস্বাভাবিক সময় ব্যবস্থাপনা। যদি সেই ক্লাসে ১২ জন শিক্ষার্থী থাকেন, তাহলে ১২*৩০ = ৩৬০ মিনিট, অর্থাৎ ৬ ঘণ্টা মানবসময় নষ্ট হলো। এই ৬ ঘণ্টা সময় শিক্ষক নিজ হাতে নষ্ট করলেন। আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন কতো ক্লাস হয়, কতো শিক্ষক দেরি করেন, কতো ব্যাচ সময়ের অপচয়ের শিকার হয়?
যে সমাজ সময়ের মূল্য বোঝে না, সে সমাজ কখনই উন্নত হতে পারে না। আর সময়কে সবচেয়ে অবমূল্যায়ন করা হয় আমাদের শিক্ষাঙ্গনেই, এটাই দুঃখের বাস্তবতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা শুধু পাঠ্যসূচির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এখানে সময় ব্যবস্থাপনা, কর্মশৃঙ্খলা, পেশাগত আচরণ, নৈতিকতা এসবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যখন শিক্ষক সময়কে সম্মান করেন না, তখন শিক্ষার্থীর অবচেতনে দুটো ধারণা তৈরি হয়- দেরিতে আসা স্বাভাবিক সময় নষ্ট করা বড় কোনো সমস্যা নয়। এই মানসিকতা নিয়ে একজন শিক্ষার্থী যখন চাকরি ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন দেখা যায় তিনি মিটিংয়ে দেরি করেন, ডেডলাইন মিস করেন, এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। এগুলো তাদের ব্যক্তিগত ক্যারিয়ারেই শুধু ক্ষতি করে না, পুরো সমাজকেই ধীরে ধীরে অকার্যকর করে তোলে। অনেক শিক্ষক সত্যিই আন্তরিক। কেউ কেউ ক্লাসের বাইরে সময় দেন, পরামর্শ দেন, গবেষণায় সাহায্য করেন, এদের প্রতি শ্রদ্ধা অটুট। কিন্তু কিছু শিক্ষকের অনিয়ম পুরো পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।
শিক্ষকরা নিশ্চয়ই ব্যস্ত থাকেন। তারা কমিটি, সেমিনার, গবেষণা নিয়ে হাজারো কাজে যুক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল সেবা হলো ঃবধপযরহম অর্থাৎ শিক্ষাদান। তাই ক্লাসে সময়মতো আসা, সময়মতো শেষ করা, এটা শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনো ভিক্ষাদানের মতো কোনো বিষয় না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী দুপক্ষই সমানভাবে দায়বদ্ধ। শিক্ষার্থী যেমন সময় মেনে আসবে, উপস্থিত থাকবে, নিয়ম মেনে চলবে, তেমনি শিক্ষকও সময়ের প্রতি একইরকম শ্রদ্ধাশীল হতে বাধ্য।
কারণ, জ্ঞানকে সম্মান করতে হলে আগে সময়কে সম্মান করতে হয়। সময় যেন কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সময় ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন যেমন- শিক্ষক দেরি করলে যুক্তিসহ রিপোর্ট। ক্লাস শিডিউল মেনে চলায় নজরদারি। অতি-লেকচারের সীমা নির্ধারণ ও সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিয়মিত সচেতনতা। কারণ একটা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। আর যদি তাদের সময়ই সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হয়, তাহলে উন্নতির স্বপ্ন কোনো ভিত্তিতে দাঁড়াবে? বলে রাখা ভালো, শিক্ষিত সমাজের পূর্ব শর্ত হলো শৃঙ্খলাবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা।
নুরুল্লাহ আলম নুর
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়