ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফ্রিল্যান্সিং বাজারে অনিয়ম ও প্রতারণা

আরিফুল ইসলাম রাফি
ফ্রিল্যান্সিং বাজারে অনিয়ম ও প্রতারণা

বাংলাদেশে গত এক দশকে ফ্রিল্যান্সিং এমন এক সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত হয়েছে, যেখানে তরুণরা নিজেদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন। প্রযুক্তির বিস্তার, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং কাজের প্রতি তরুণদের আগ্রহ এই বাজারকে দ্রুত বড় করেছে। দেশে এখন আট থেকে ১০ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন বলে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়। তারা ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ভিডিও এডিটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স, কন্টেন্ট রাইটিংসহ অসংখ্য খাতে যুক্ত। কিন্তু এই বিপুল সম্ভাবনার আড়ালে রয়েছে আরও এক বড় বাস্তবতা; অনিয়ম, প্রতারণা, ভুল তথ্য, ভুয়া ট্রেনিং সেন্টার, মিথ্যে আয়, স্ক্যাম এবং নানারকম আর্থিক ক্ষতি।

এই অন্ধকার অংশটি যতটা চেপে রাখা হয়েছে, তার প্রভাব তরুণদের ভবিষ্যৎ, দেশের অর্থনীতির আস্থা ও ডিজিটাল বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

ফ্রিল্যান্সিংকে ঘিরে দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে যেসব প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, তার বেশির ভাগই বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা ব্যক্তিগত প্রশিক্ষক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেন, ‘৩ মাসে ৫০ হাজার আয়’, ‘মাসে ১ লাখ ইনকাম নিশ্চিত’, ‘ডলার ইনকাম করে জীবন পাল্টে ফেলুন’। এমন চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে হাজারও তরুণ কোর্সে ভর্তি হন। অথচ কোনো আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে প্রতিযোগিতামূলকভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে লাগবে গভীর দক্ষতা, নিত্য অনুশীলন এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো দেশ দক্ষতা, ভাষাজ্ঞান, সময় ব্যবস্থাপনা এবং পেশাদারিত্বে এগিয়ে। ফলে বাংলাদেশি অনেক নবীন ফ্রিল্যান্সার প্রথম থেকেই এক অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েন।

সবচেয়ে বড় অনিয়মের জায়গা হলো ভুয়া বা নিম্নমানের ট্রেনিং সেন্টার। অনেক প্রতিষ্ঠান অতিরঞ্জিত আয় দেখিয়ে কোর্স বিক্রি করে। বিজ্ঞাপনে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের গল্প দেখানো হয়, যেখানে ফটোশপ করা স্ক্রিনশট, অন্যের অ্যাকাউন্ট বা কৃত্রিম প্রমাণ ব্যবহার করা হয়। তিন মাসে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং বা ভিডিও এডিটিং শেখানো সম্ভব বলে দাবি করা হয়, যা বাস্তবতা থেকে বহু দূরের কথা। কেউ কেউ শিক্ষার্থীর ফাইভার বা আপওয়ার্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে বলেন যে ‘এক সপ্তাহের মধ্যে অর্ডার পাবেন’; কিন্তু কোনো অর্ডার না পেয়ে শিক্ষার্থী হতাশ হন, অ্যাকাউন্টও সাসপেন্ড হয়ে যায়। ‘ইনকাম গ্যারান্টি’ নামে প্রতারণা তো আরো ভয়ংকর, কোর্সের শেষে বলা হয় ইউটিউব চ্যানেল খুললে বা অ্যাপ বানালে ডলার আয় হবে। বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো আয় হয় না।

আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসেও প্রতারণার অভাব নেই। অনেক ক্লায়েন্ট ট্রায়াল ওয়ার্ক বা স্যাম্পল দেওয়ার কথা বলে বিনা পয়সায় কাজ করিয়ে নেয়, তারপর আর ফিরতি বার্তা দেয় না। বিশেষ করে ফাইভারে অনেক ক্লায়েন্ট ডেলিভারি নেওয়ার পর রিফান্ড চায় বা ব্যাংকের মাধ্যমে চার্জব্যাক করে; এতে ফ্রিল্যান্সার পেমেন্ট হারানোর পাশাপাশি অ্যাকাউন্টের সুনাম হারায়। কেউ কেউ অযথা কাজের মান নিয়ে বিতর্ক করে পেমেন্ট কমায়। আবার অনেকে অফ-প্ল্যাটফর্মে বেশি অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রলুব্ধ করে, অথচ পেমেন্ট দেয় না; বরং এতে অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শুধু ক্লায়েন্ট নয়, ফ্রিল্যান্সার সমাজের মধ্যেও অনিয়ম আছে। ‘গ্রুপ বায়িং’ নামে কোর্স শেয়ার করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নিয়ে উধাও হওয়া এখন খুব সাধারণ। টপ-রেটেড কিছু ফ্রিল্যান্সার নবীনদের দিয়ে কাজ করিয়ে পেমেন্ট না দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। আবার সফটওয়্যার, টেমপ্লেট বা ডিজাইন চুরি করে বিক্রি করা অনেকের ব্যবসা হয়ে গেছে। এসব কাজ শুধু অনৈতিকই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে দেশের ফ্রিল্যান্সারদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।

‘আউটসোর্সিং এজেন্সি’ নামে প্রতারণা চলছে। কেউ কেউ নিজেদের আমেরিকা বা ইউরোপের কোম্পানি দাবি করে কন্টেন্ট রাইটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স, কল সাপোর্ট ইত্যাদির কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রথমে কয়েক হাজার টাকা ‘সিকিউরিটি মানি’ বা ‘রেজিস্ট্রেশন ফি’ নেয়, তারপর কয়েকটা ছোট কাজ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাদের ওয়েবসাইট, লিঙ্কডইন প্রোফাইল, চুক্তিপত্র- সবই ভুয়া।

ডলার লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রতারণা আরও বিপজ্জনক। অনেকেই ‘ডলার সেল-বাই’ গ্রুপে প্রতিদিন প্রতারিত হন। কেউ ডলার পাঠানোর পর টাকা না পেয়ে ব্লকড হয়ে যান। পেপাল বা পেওনিয়ারের ভুয়া লগইন পেজ পাঠিয়ে আইডি হ্যাক করার ঘটনাও অনেক। ‘১,০০০ টাকায় পেপাল অ্যাকাউন্ট’ এমন অফার দেওয়া হয়, যেখানে দেওয়া হয় চুরি করা বা সীমাবদ্ধ অ্যাকাউন্ট, যা অল্পদিনেই বন্ধ হয়ে যায়।

মার্কেটপ্লেসে ভুয়া সার্টিফিকেট বা রেটিং বাড়ানোর প্রবণতাও সমস্যার বড় উৎস। অনেকে গুগল, হাবস্পট বা ইউডেমির সার্টিফিকেট এডিট করে যুক্ত করেন। আবার পাঁচ ডলারের ভুয়া রিভিউ, আত্মীয়-বন্ধুকে দিয়ে অর্ডার করানো বা নিজে ভুয়া আইডি তৈরি করে রিভিউ দেওয়া সাধারণ ব্যাপার। এগুলো ধরা পড়লে অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হয়।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে সাইবার অপরাধও বাড়ছে। আপওয়ার্ক বা ফাইভারের নাম করে ভুয়া লিংক পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট হ্যাক, ক্লোনড ওয়েবসাইট ব্যবহার করে তথ্য চুরি, র‍্যানসমওয়্যার দিয়ে কম্পিউটার লক- এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ হাজার ফ্রিল্যান্সার সাইবার প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে CERT এর তথ্য বলছে।

ফ্রিল্যান্সিং বাজারকে টেকসই করতে হলে এই অনিয়ম মোকাবিলা জরুরি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা, ভুয়া আয় দেখিয়ে বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা, সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে বিশেষ ইউনিট গঠন এবং ক্লায়েন্ট-ফ্রিল্যান্সার সুরক্ষা কাঠামো তৈরি করা প্রয়োজন। তরুণদেরও সতর্ক হতে হবে, অতিরঞ্জিত প্রচারণায় বিশ্বাস করা নয়, বরং দক্ষতা অর্জনে সময় দেওয়া জরুরি। ছোটখাটো স্ক্যাম বা দ্রুত আয় হবে এমন স্বপ্নের পেছনে দৌড়ালে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিই হয়।

ফ্রিল্যান্সিং বাজারে অনিয়ম আছে, প্রতারণাও আছে; কিন্তু একই সঙ্গে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। যদি বাজারটি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, দক্ষতার উন্নয়ন হয় এবং তরুণরা সচেতন হয়, তাহলে এই খাত দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম বড় উৎসে পরিণত হতে পারে। প্রতারণার ধুলো সরিয়ে প্রকৃত সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সাররা বিশ্বব্যাপী নিজেদের শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে পারবেন দক্ষতা, সততা ও আত্মনিবেদনের মাধ্যমে।

আরিফুল ইসলাম রাফি

শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত