ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল ‘ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প’

আসমা ফেরদৌসি
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল ‘ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প’

বাংলাদেশের ষষ্ঠতম বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেল ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প। ভারতের লাল কেল্লায় অনুষ্ঠিত ২০তম ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর আন্তঃসরকারি কমিটির অধিবেশনে গতকাল এই ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ থেকে সর্বশেষ ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ‘ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র’ ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারার হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

মূলত বিশ্বের বিভিন্ন বিমূর্ত বা স্পর্শাতীত শিল্প সুরক্ষার্থে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সারা বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কোর ২০০৩ সালে কনভেনশনের উপর ভিত্তি করে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশের বিশ্ব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে প্রথমভাগে ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর আন্তঃসরকারী কমিটির চূড়ান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইউনেস্কোর নিয়মানুযায়ী রাষ্ট পক্ষ হিসেবে সংষ্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হয়ে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর টাঙ্গাইলের শাড়ি বুননেন নমিনেশন ফাইল তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে ইউনেস্কোর আন্তঃসরকারী কমিটির সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ও বাংলাদেশের ইউনেস্কোর স্থায়ী প্রতিনিধি এর পরামর্শে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প ফাইলটি সংশোধন ও তথ্যহালনাগাদ করে ১০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখ চূড়ান্তভাবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির জন্য প্রেরণ করা হয়। ২০২৪ সালে টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্পকে ইউনেস্কোর ২০০৩ কনভেনশনের আর্টিকাল -১২-এর অত্যাবশকীয় শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এর তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত বাংলাদেশের বিমূর্ত সংস্কৃতির অনলাইনভিত্তিক জাতীয় ইনভেন্টরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্পর স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ির দেশ হিসেবে আরেকবার বিশ্বমঞ্চে উজ্জ্বল হলো বাংলাদেশের নাম। টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প ঐতিহ্যগত কারুশিল্প উৎপাদনে জ্ঞানও দক্ষতা বা ট্রাডিশনাল ক্রাফটম্যানসিপ ক্যাটাগরিতে লিভিং বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর হিসেবে এই স্বীকৃতি মিলেছে। ইউনেস্কো থেকে প্রতিবছর ৫টি ক্যাটাগরিতে বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর উপরবিশ্বের ঐতিহ্যর অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে রয়েছে- মৌখিক ঐতিহ্য বা ওরাল ট্রেডিশনাল এন্ড এক্সপ্রেশনস, পরিবেশনা শিল্প বা পারফরমিং আর্টস, সামাজিক অনুশীলন, আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব অনুষ্ঠান বা সোসাল প্র্যাকট্রিস, রিচুয়ালস অ্যান্ড ফেসটিভস ইভেন্ট, প্রকৃতি এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কিত জ্ঞান ও অনুশীলন বা নলেজ অ্যান্ড প্র্যাকট্রিস কনর্সানিং ন্যাচার অ্যান্ড ইউনির্ভাস এবং ঐতিহ্যগত কারুশিল্প উৎপাদন করার জ্ঞান ও দক্ষতা বা ট্রাডিশনাল ক্রাফটম্যানসিপ।

এসব বির্মূত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের স্বকীয় রীতিনীতি ও জ্ঞান-দক্ষতায় তৈরি ও যা সাধারণত আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। বাংলাদেশে রয়েছে এ সব বিমূর্ত সাংস্কৃতিক উপাদানের হাজারও ভান্ডার। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর সুরক্ষার বাধ্যবাধকতা এবং প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, তাই বাংলাদেশ বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য (আইসিএইচ)-এর সুরক্ষার জন্য ইউনেস্কোর ২০০৩ কনভেনশন স্বাক্ষর করেছে। এরইমধ্যে আমাদের বাউল গান (২০০৮), ঐতিহ্যবাহী জামদানি বুনন শিল্প (২০১৩), পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা (২০১৬), সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি বুনন শিল্প (২০১৭), ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র (২০২৩) এবং সর্বশেষ যুক্ত হলো ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের শাড়ি বুনন শিল্প ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যর প্রতিনিধিত্বমূলক বা রিপ্রেজেনটেটিভ লিস্ট অফ দ্যা ইনটেনজিবল কালচারার হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবার স্বীকৃতি অর্জন করেছে।

বাঙালির আদিতম ঐতিহ্যের অংশ এই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। এই শাড়িতে একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ও মোটিফ রয়েছে যা, অন্যান্য বুনন থেকে স্বতন্ত্রতা এনে দিয়েছে। টাঙ্গাইল অঞ্চলে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই শাড়িকে ‘টাঙ্গাইলের শাড়ি’ নামে অভিহিত করা হয়। এখানকার তাঁতিরা বিশ্বাস করে টাঙ্গাইল অঞ্চলের জলবায়ু এই শাড়ি তৈরির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। টাঙ্গাইলের তাঁতিরা ছোটবেলা থেকে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে দেখে দেখে শাড়ি বুননের কৌশল রপ্ত করে থাকে।

টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন এর প্রধান কারিগর বসাক ও জোলা। বসাকরা হিন্দু সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে আর জুলারা মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে। এ অঞ্চলের তাঁতিরা নান্দনিক নকশাযুক্ত সুক্ষতম শাড়ি তৈরি করে। টাংগাইলের তাঁতিরা শুধু শাড়ি বুনন নয়, সেলোয়ার, কামিজ, গজ কাপড়, পাঞ্জাবিসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় বুনে থাকে। টাংগাইল অঞ্চলের তাঁতিরা তাদের শাড়ির প্রতিটি অংশ অত্যন্ত যত্ন সহকারে তুলে ধরে যা, বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গল্প কে ফুটে ওঠে।

এককালে বাংলাদেশের নারীদের প্রত্যাহিক পড়ার জন্য একমাত্র ভরসা ছিল এই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। যা এদেশকে প্রতিনিধিত্ব করত। আশির দশক থেকে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে এসেছে ভিন্নতা। তাই, বাঙালির আটপৌরে , উৎসবে, পূজা-পার্বণে বা বিভিন্ন দিবসে বাঙালির পছন্দের তালিকায় রয়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইলের পাথরাইল, চন্ডী ও আশেপাশে প্রায় ৫০০ পরিবার এই তাঁত বুননের সঙ্গে জড়িত। এখানকার তাঁতিরা পিটলুম ও চিত্তরঞ্জন তাঁত বুনন পদ্ধতি ব্যবহার করে। পিটলুম পদ্ধতি হলো হস্ত চালিত যা সনাতনী তাঁত নামেও পরিচিত। এটি একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যগত পদ্ধতি। আর চিত্তরঞ্জন তাঁত হচ্ছে মেশিন চালিত। এতে গ্রাফ কাগজে বা কম্পিউটারে নকশা করে তা পাঞ্চ করে জ্যার্কাডে নকশা তুলে তা মেশিনের মাধ্যমে শাড়ি তৈরি করা হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি বলতে সাধারণত সুতি শাড়ি বোঝালেও এখানকার তাঁতিরা সিল্ক, হাফসিল্ক, এ্যান্ডি, কৃত্রিম সিল্ক, মাসলাইস কটন শাড়ি তৈরি হয়। নকশার দিক থেকে টাঙ্গাইল শাড়িতে রয়েছে বৈচিত্র্যতা ।

ইউনেস্কোর বিমূর্ত সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ থেকে স্বীকৃতির ফলে নতুন করে টাঙ্গাইল শাড়ি বুনন শিল্প সুরক্ষার পথ প্রসারিত হলো। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এ স্বীকৃতির ফলে টাঙ্গাইলের তাঁতিরা আরও উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে যাবে এবং এ শিল্পকে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে কাছে ছড়িয়ে দিবে। সারাবিশ্বে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং হিসেবে কাজ করবে। টাঙ্গাইল শাড়ির দেশ হিসেবে বিশ্ব আরেকবার চিনবে বাংলাদেশকে।

আসমা ফেরদৌসি

কিপার (জনশিক্ষা বিভাগ), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত