ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চিয়া সিড : ক্ষুদ্র বীজে লুকানো বিশাল পুষ্টি

আনাস রাফি
চিয়া সিড : ক্ষুদ্র বীজে লুকানো বিশাল পুষ্টি

বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসচেতন প্রজন্মের দিকে তাকালে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট খাদ্যাভ্যাসে আমূল পরিবর্তন আসছে। ভাতের প্লেট ছোট হচ্ছে, বাড়ছে সালাদ আর অর্গানিক ফুডের কদর। আর এই পরিবর্তনের জোয়ারে যে নামটি এখন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, তা হলো, ‘চিয়া সিড’। এটি শরীর ওজন কমাতে কার্যকরী ও ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে খুবই উপকারী। বর্তমানে এটির প্রচলন ব্যাপক হারে শুরু হয়েছে।

‘ঘরের বাজার ডটকম’-এর জামশেদ মজুমদার থেকে শুরু করে ফেসবুকের নিউজফিড দখল করে থাকা অজস্র অনলাইন সেলার, সবার প্রচারণায় চিয়া সিড এখন তুঙ্গে। চিয়া সিডের নাম শোনেননি এমন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। একসময় যা ছিল ভিনদেশি অচেনা বীজ, তা এখন বাঙালির রান্নাঘরের নিয়মিত সদস্য। স্বাস্থ্যসচেতন প্রজন্মের কাছে এই ছোট্ট বীজটি যেন এক ধরনের ‘সুপারফুড আইকন”। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কি শুধুই মার্কেটিং আর সোশ্যালমিডিয়া ট্রেন্ড, নাকি এর পেছনে আসলেই কোনো শক্ত বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে? চিয়া সিডের সেই বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা, পুষ্টিগুণ এবং এর সঠিক ব্যবহারের খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করব।

চিয়া সিড কোনো ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা সাপ্লিমেন্ট নয়, এটি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। এর উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Salvia hispanica। উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী এটি লামিয়াসি বা পুদিনা পরিবারের (Lamiaceae) সদস্য।

চিয়ার আদি নিবাস মেক্সিকো ও গুয়াতেমালা। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, প্রাচীন অ্যাজটেক ও মায়া সভ্যতায় এই বীজ ছিল শক্তির উৎস। ‘চিয়া’ শব্দটি মায়া শব্দ, যার অর্থই হলো ‘শক্তি’।

যদিও এটি মেক্সিকোর স্থানীয় উদ্ভিদ, কিন্তু এর অসাধারণ পুষ্টিগুণের কারণে এটি এখন আর কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানায় আটকে নেই, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। দেখতে খুব ছোট, ডিম্বাকার, অনেকটা তিলের মতো এই বীজটি সাদা, কালো বা ধূসর রঙের হতে পারে। তবে রঙের ভিন্নতা থাকলেও পুষ্টিগুণে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

প্রতি ১০০ গ্রামের হিসাব : চিয়া সিডকে কেন ‘পুষ্টির পাওয়ারহাউজ’ বলা হয়, তা এর পুষ্টি উপাদান বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়। আধুনিক ডায়েটেশিয়ানরা এর নিউট্রিশনাল প্রোফাইল দেখে একে খাদ্যতালিকায় রাখার পরামর্শ দেন। প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া সিডে যে পুষ্টি উপাদানগুলো থাকে, তা রীতিমতো চমকপ্রদ।

১. শক্তি : এতে রয়েছে প্রায় ৪৮৬ কিলোক্যালরি। যা শরীরে দীর্ঘক্ষণ কাজ করার শক্তি যোগায়। ২. কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার : এতে মোট কার্বোহাইড্রেট আছে ৪২ গ্রাম। তবে চমকপ্রদ তথ্য হলো, এর মধ্যে প্রায় ৩৪-৩৫ গ্রামই ফাইবার। অর্থাৎ, এতে ‘নেট কার্ব’ খুবই কম, যা লো-কার্ব ডায়েট বা কিটো ডায়েটের জন্য আদর্শ। ৩. প্রোটিন : উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের অন্যতম সেরা উৎস এটি। প্রতি ১০০ গ্রামে মিলবে ১৬-১৭ গ্রাম প্রোটিন। যারা নিরামিষভোজী বা ভেগান, তাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে এটি দারুণ কার্যকর। ৪. ফ্যাট ও ওমেগা-৩ : এতে ফ্যাট রয়েছে ৩০-৩১ গ্রাম। তবে ভয় পাবেন না, এর বড় অংশই হলো স্বাস্থ্যকর ফ্যাট বা পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, বিশেষ করে ওমেগা-৩ (ALA)। ৫. খনিজ উপাদান : শরীরের অত্যাবশ্যকীয় মিনারেল যেমন- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ফসফরাসসহ প্রয়োজনীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট এতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।

শুধু তাই নয়, চিয়া সিডে কুয়েরসেটিন (Quercetin), ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড (Chlorogenic acid) এবং কাইমফেরল (Kaempferol)-এর মতো শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলো আমাদের শরীরের কোষকে ‘অক্সিডেটিভ স্ট্রেস’ থেকে রক্ষা করে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে এবং বার্ধক্য রোধে সহায়ক।

চিয়া সিডের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর পানি শোষণ ক্ষমতা। এই বীজ যখন পানির সংস্পর্শে আসে, তখন এটি নিজের ওজনের ১০-১২ গুণ পানি শুষে নিতে পারে। এর ফলে বীজের চারপাশে একটি জেলির মতো আবরণ তৈরি হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় এই বিশেষ ‘জেল-স্ট্রাকচার’ই চিয়ার বহু স্বাস্থ্য উপকারিতার চাবিকাঠি।

ওজন কমাতে সাহায্য করে : চিয়া সিডের উচ্চ ফাইবার, বিশেষ করে এর দ্রবণীয় ফাইবার (Soluble Fiber) পানির সঙ্গে মিশে যে জেল তৈরি করে, তা খাওয়ার পর পাকস্থলীতে গিয়ে ভলিউম বা আয়তন বাড়িয়ে দেয়। এতে মস্তিষ্ক সংকেত পায় যে পেট ভরা আছে। ফলে ক্ষুধা কমে যায় এবং বারবার খাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়। যারা ওজন কমাতে চান, তাদের জন্য এটি একটি প্রাকৃতিক ‘খিদে কমানোর ওষুধ’ হিসেবে কাজ করতে পারে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিয়া সিড একটি আশীর্বাদ। এর জেল-ম্যাট্রিক্স খাবার হজমের প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। ফলে আমরা যখন শর্করা জাতীয় খাবার খাই, তা দ্রুত ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজ ধীরে ধীরে নিঃসৃত হয়। গবেষণা অনুযায়ী, এটি খাদ্যের ‘গ্লাইসেমিক রেসপন্স’ কমায় এবং খাওয়ার পর ইনসুলিনের দ্রুত ওঠা-নামা (Insulin Spike) রোধ করে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

হৃৎপিণ্ড ও হাড়ের সুরক্ষায় চিয়া : হার্ট ভালো রাখতে চিয়া সিডের জুড়ি মেলা ভার। এতে থাকা প্লান্ট-বেসড ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন কমায়। এটি রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে লিপিড প্রোফাইল উন্নত করে, যা ব্লকেজ ও হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর।

অন্যদিকে, হাড়ের সুরক্ষায় আমরা সাধারণত দুধের কথা ভাবি। কিন্তু অবাক করা তথ্য হলো, চিয়া সিডে দুধের চেয়েও বেশি ক্যালসিয়াম থাকতে পারে (গ্রামের অনুপাতে)। এর ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, আর ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়ামের ত্রয়ী সমন্বয় হাড়ের ঘনত্ব বৃদ্ধিতে সহায়ক। বয়সের সাথে সাথে হাড় ক্ষয় রোধে এটি দারুণ কার্যকরী।

পরিপাকতন্ত্র ও হাইড্রেশন : অনেকেই দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। চিয়া সিডের উচ্চ ফাইবার কন্টেন্ট অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা মাইক্রোবায়োমকে সমৃদ্ধ করে। এটি মলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে বাওয়েল মুভমেন্ট স্বাভাবিক রাখে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে থাকে।

চিয়াসিডের জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যভাসে এটি সংযোজন হতে শুরু করেছে। আমাদের উচিত এর উৎপাদন বাড়িয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌছে দেওয়া। যাতে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীও সহজেই পুষ্টির ছোঁয়া পায়।

আনাস রাফি

উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত