ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

স্বাদু পানির মাছ কমে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

হেনা শিকদার
স্বাদু পানির মাছ কমে যাচ্ছে, প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

নদীমাতৃক বাংলাদেশ- এই শব্দবন্ধটি একসময় কেবল পাঠ্যবইয়ের বুলি ছিল না, ছিল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষায় থৈ থৈ করা বিলে মাছের দাপাদাপি, জালের রুপালি ফসলে জেলের মুখে হাসি, আর পাতে ভাপে সিদ্ধ বা ঝোল করা দেশি মাছের স্বাদণ্ডবাঙালির সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আজ হুমকির মুখে। আমাদের স্বাদুপানির মাছ বা দেশি মাছের ভান্ডার আজ আশঙ্কাজনক হারে ফুরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি কেবলই আমাদের রসনার তৃপ্তি বা আমিষের অভাব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়?

হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও বর্তমান বাস্তবতা : বেশি দিন আগের কথা নয়, গ্রামবাংলার খাল-বিল, হাওর-বাওড় ছিল দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র। পাবদা, টেংরা, পুঁটি, খলিসা, মলা, ঢেলা, শোল, গজার নামগুলো বলে শেষ করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN)-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এর একটি বিশাল অংশ বিপন্ন, অতি বিপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে। আমরা এখন বাজারে যে মাছ দেখি, তার বড় অংশই চাষের মাছ পাঙাস, তেলাপিয়া কিংবা হাইব্রিড কই। এই মাছগুলো আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সত্য, কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের যে অভাব তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।

কেন এই বিপন্নতা : মাছ কমে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই, বরং এটি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। উন্নয়নের নামে নদী, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন বা শিল্পকারখানা। মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র বা ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য এবং কৃষিজমিতে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে।

কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন মাছের বংশবিস্তারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা এবং তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে : এখন মূল প্রশ্নটি হলো- এখানেই মাছ কমে গেলে পরিবেশের কী এমন ক্ষতি হবে? উত্তর হলো, বিপর্যয় হবে সুদূরপ্রসারী।

খাদ্যশৃঙ্খলে ধস : স্বাদুপানির মাছ শুধু মানুষের খাদ্য নয়, এটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের (Food Chain) একটি অপরিহার্য অংশ। মাছ কমে গেলে মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ি এবং ভোঁদড়ের মতো প্রাণীরা খাদ্য সংকটে পড়ে। এরইমধ্যে গ্রামবাংলা থেকে অনেক মাছশিকারি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পানির গুণাগুণ রক্ষা : অনেক প্রজাতির মাছ (যেমন- আবর্জনাভুক মাছ বা Scavenger fish) পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এরা পচনশীল দ্রব্য খেয়ে জলাশয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মাছ না থাকলে জলাশয়গুলো দ্রুত দূষিত হবে এবং মশা-মাছির উপদ্রব বাড়বে।

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য : জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং প্লাঙ্কটনের ভারসাম্য রক্ষায় মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের অভাব পুরো জলজ পরিবেশকে মৃতপ্রায় বা ‘Dead Zone’-এ পরিণত করতে পারে।

সুতরাং, মাছ কমে যাওয়া মানে কেবল খাবারের প্লেটে সংকট নয়, বরং পুরো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার সতর্কবার্তা।

অর্থনৈতিক ও পুষ্টির সংকট : গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-এ এর প্রধান উৎস ছিল ছোট মাছ। এই মাছগুলো হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এছাড়া, যারা বংশপরম্পরায় জেলের পেশায় জড়িত, নদীতে মাছ না পেয়ে তারা আজ বেকার। বাধ্য হয়ে তারা পেশা পরিবর্তন করছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

হতাশার মধ্যেও আশার আলো হলো, প্রকৃতিকে সুযোগ দিলে সে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ।

মৎস্য অভয়াশ্রম বৃদ্ধি : হাওর ও নদীগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সারা বছরের জন্য বা প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

দূষণ রোধ : শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার আগে শোধন (ETP ব্যবহার) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জনসচেতনতা ও আইন প্রয়োগ : কারেন্ট জাল বা বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

জলাশয় পুনরুদ্ধার : ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

স্বাদুপানির মাছ রক্ষা করা কেবল মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নদী বাঁচলে মাছ বাঁচবে, আর মাছ বাঁচলে টিঁকে থাকবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে জানবে, একদা এ দেশে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামে একটি জাতি ছিল।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র টিকে থাকবে কি না, তার উত্তর নির্ভর করছে আজ আমরা প্রকৃতির প্রতি কতটা সদয় আচরণ করছি, তার ওপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।

হেনা শিকদার

শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত