প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫
কিছুদিন আগের একটি ঘটনার দৃশ্য মনে করলে এখনও গা শিউরে ওঠে। প্রকাশ্য দিবালোকে, শত শত মানুষের সামনে একজনকে পাথর চাপা দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। চারপাশে অসংখ্য মানুষ ছিল, কিন্তু প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের সামান্যতম স্পৃহা ছিল না। সবাই কেবল দর্শক হয়ে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত থাকল। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আমরা দেখলাম দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে গুলি বা ছুরিকাঘাতের ঘটনা। চোখের পলকে মানুষের প্রাণ ঝরে যাচ্ছে, অথচ আশপাশের মানুষ যেন জড়বস্তু। কেন এই চরম নির্বিকার আচরণ? এর পেছনে অপরাধীদের ভয়ের সংস্কৃতি অবশ্যই আছে, তবে বর্তমান সময়ে এর চেয়েও বড় একটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা বা ‘জুজু’ সাধারণ মানুষের হাত-পা বেঁধে ফেলছে। সেই জুজুটি হলো- ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া’ বা ‘মব জাস্টিস’-এর অপবাদ।
মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের কথা বলতে গিয়ে আমরা সমাজে এমন একটি সামাজিক বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরি করেছি, যা মানুষকে অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও দ্বিধান্বিত করে তুলেছে। কেউ যদি চোখের সামনে ঘটা কোনো নৃশংস আক্রমণ রুখতে অপরাধীর ওপর চড়াও হয়, তখন তাকে শুনতে হয়, ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’। এই একটি বাক্যই সমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে অপরাধীদের সাহস জোগাচ্ছে।
মব জাস্টিস’ বা গণপিটুনি দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যা অবশ্যই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু আমাদেরকে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝতে হবে। যখন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, অর্থাৎ কেউ যখন কাউকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে কিংবা ধর্ষণ করছে, তখন সেই মুহূর্তে বলপ্রয়োগ করে অপরাধীকে থামানোটা ‘আইন নিজের হাতে তোলা’ নয়, বরং সেটা ‘নাগরিক প্রতিরোধ’।
কিন্তু আমাদের শেখানো হচ্ছে, শান্ত থাকুন, পুলিশকে খবর দিন। পুলিশকে খবর দেওয়া এবং পুলিশের ঘটনাস্থলে পৌঁছানো, এই দুইয়ের মাঝখানে যে সময়ের ব্যবধান, সেই সময়ে আমরা কী করব? কেউ যখন বাঁচার জন্য আকুতি করে, তখন কি আমরা ৯৯৯-এ কল দিয়ে পুলিশের জন্য অপেক্ষা করব? কিন্তু পুলিশ আসা পর্যন্ত যে ২০-৩০ মিনিট সময় লাগে, সেই সময়ে তো একটি জীবন বা সম্ভ্রম সব শেষ হয়ে যেতে পারে। বাস্তবতা হলো, অপরাধ ঘটার মুহূর্তে পুলিশ থাকে না, থাকে জনগণ। জনগণ যদি ‘আইন হাতে না নেওয়া’-র ভয়ে চুপ থাকে, তবে অপরাধীরাই পুরস্কৃত হয়। তারা জানে, পাবলিক এখন আর ধাওয়া করে না, ভিডিও করে। পাবলিক ভয় পায়, পাছে তাকেই আবার হামলাকারী হিসেবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় কি না।
অনেকেই হয়তো জানেন না, বাংলাদেশের আইন কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আপনাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পরামর্শ দেয় না। দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, ১৮৬০)-এর ৯৬ থেকে ১০৬ ধারায় ‘ব্যক্তিগত আত্মরক্ষার অধিকার’ সম্পর্কে স্পষ্ট বলা হয়েছে। বিশেষ করে ৯৭ ধারা অনুযায়ী, নিজের এবং অন্যের শরীর রক্ষা করার অধিকার আপনার আছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ১০০ এবং ১০৩ ধারা। এই ধারায় বলা হয়েছে- মৃত্যু, গুরুতর আঘাত, ধর্ষণ বা অপহরণের মতো অপরাধ ঘটার আশঙ্কা থাকলে, ভুক্তভোগীকে বাঁচাতে হামলাকারীর ওপর শক্তি প্রয়োগ করা, এমনকি তাতে হামলাকারীর মৃত্যু ঘটলেও তা আইনত অপরাধ নয়। অর্থাৎ, আইন আপনাকে সুরক্ষা দিয়েছে, অথচ প্রচারণার অভাবে আমরা ভাবি গায়ে হাত তুললেই বুঝি আমি অপরাধী।
আমরা সমাজকে এমনভাবে গড়েছি যেখানে অপরাধীর মানবাধিকার নিয়ে আমরা যতটা সোচ্চার, ভুক্তভোগীকে তাৎক্ষণিক রক্ষা করার বিষয়ে ততটাই অস্পষ্ট। ‘আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না’, এই কথাটি ঢালাওভাবে প্রচার না করে বলা উচিত, ‘অপরাধ ঘটার সময় প্রতিরোধ করুন, কিন্তু অপরাধী ধরা পড়ার পর তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিন’।
আমাদের সমাজ তার প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা এখন কেবল অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর বিচার চাইতে পারি। কিন্তু অপরাধ ঘটার মুহূর্তে যে সাহসিকতা দরকার, তা আইনি মারপ্যাঁচ আর সমালোচনার ভয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সবসময় সব জায়গায় থাকতে পারে না। দুর্বৃত্তদের রুখতে হলে উপস্থিত মানুষকেই ঢাল হতে হবে। কাউকে ধর্ষণ বা খুন হওয়া থেকে বাঁচাতে শক্তি প্রয়োগ করা ‘মব জাস্টিস’ নয়, বরং সেটাই সর্বোচ্চ মানবতা এবং আইনসম্মত কাজ। দর্শক হয়ে ভিডিও করার চেয়ে, প্রতিরোধ করে জীবন বাঁচানোই এখন সময়ের দাবি।
ইব্রাহীম খলিল (সবুজ)
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়