ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

খাদ্যদূষণ : এক নীরব ঘাতক ও জাতীয় সংকট

খাদ্যদূষণ : এক নীরব ঘাতক ও জাতীয় সংকট

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী খাদ্যবাহিত রোগে আক্রান্ত এক-তৃতীয়াংশ শিশু মারা যাইতেছে- এই পরিসংখ্যানটি নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৬০ কোটি এবং আমাদের বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি শিশু খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। বলিতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের খাদ্যপণ্যে দূষণ ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি এখন মহামারি আকার ধারণ করিয়াছে। ইহা একটি জাতীয় সংকট নিঃসন্দেহে। দেশের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সূত্রমতে, আমাদের খাবারে ভারী ধাতু, কীটনাশক ও জীবনাশকের অবশিষ্টাংশ, তেজস্ক্রিয়তা এবং জৈবদূষক- এই চার ধরনের দূষকের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। সম্প্রতি ৮১৪টি নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে খাবারে অতিরিক্ত মাত্রায় সিসা বা সিসা ক্রোমেট পাওয়া গিয়াছে। ইহা মানবদেহে প্রবেশ করিয়া মস্তিষ্ক, যকৃৎ, কিডনি, হাড় ও দাঁতে জমা হয়। শিশুদের হাড় নরম হওয়ায় তাহা সরাসরি মস্তিষ্কে চলিয়া যায়; অর্থাৎ তাহাদের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। এই জন্য ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি শিশু সিসার সংক্রমণে ভুগিতেছে। ৫ শতাংশ গর্ভবতী নারীর দেহেও এই বিষাক্ত ভারী ধাতুর সংক্রমণ রহিয়াছে। সিসার মতো উপাদান মানবদেহে ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্র ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। বিশেষ করিয়া ইহা শিশুদের বুদ্ধিমত্তা ও স্বাভাবিক বিকাশে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কৃষি কর্মকর্তারাও হাঁস-মুরগির খামারগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ প্রয়োগের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করিতেছেন। মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ফলে ইহার নেতিবাচক প্রভাব ৭ হইতে ২৮ দিন পর্যন্ত থাকিতে পারে। নির্ধারিত সময়সীমার আগেই সেই মাংস বাজারজাত করা হইলে, অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের মানবদেহে প্রবেশ করে। ফলে আমরা যখন সত্যিই অসুস্থ হই, তখন ওই অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না, যাহা চিকিৎসাকে আরও কঠিন করিয়া তোলে।

মূলত খাদ্যদূষণ শুরু হয় খাবারের কাঁচামাল তৈরি হইতে। কৃষকের চাষাবাদের সময় রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো হইতে এই দূষণের সূত্রপাত হয়। ইহার পর সেই কাঁচামাল সংরক্ষণ করিবার জন্য রাসায়নিক দ্রব্য মিশাইয়া বাজারজাত করা হয়। অতঃপর হোটেলগুলো যখন খাবার তৈরি করে, তখন তৃতীয় স্তরের খাদ্যদূষণ হয় ও মানুষ তাহা ক্রয় করে। সরকার খাদ্যে দূষণ প্রতিরোধের জন্য এই যাবৎ বেশ কয়েকটি আইন তৈরি করিয়াছে; যথা: দণ্ডবিধি-১৮৬০: বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪; ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯; খাদ্যনিরাপত্তা আইন, ২০১৩; ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৫। কিন্তু এই সকল আইনের প্রয়োগ কতটা হইতেছে, তাহাই বড় প্রশ্ন। বিশেষত ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(গ)-এর ১(ঙ) ধারায় দূষিত তথা ভেজাল খাবারের অপরাধ প্রমাণ হইলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন বা ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধানের কথাও বলা হইয়াছে। কিন্তু এই আইনের আওতায় কাহারো শাস্তির নজির নাই।

সমস্যা হইল, অধিকাংশ জনগণ মনে করে না ভেজাল খাবার বা খাদ্যদূষণ একটি অপরাধ। তাহারা বুঝিতেই পারে না যে, দূষিত বা ভেজাল খাদ্য নীরবে জনগণকে হত্যা করিতেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার রাষ্ট্রীয় অতিধি ভবন যমুনায় এক বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের খাদ্যপণ্যে দূষণ ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতিতে যেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। এই সংকট মোকাবিলায় শুধু সরকারের ভূমিকা নহে, প্রতিটি নাগরিকের সচেতনতা অপরিহার্য। উৎপাদন পর্যায়ে কৃষকদের কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার, খামারিদের ওষুধ প্রয়োগের বিধিনিষেধ মানা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে নৈতিকতা বজায় রাখা আবশ্যক। সরবরাহ ও বাজারজাত করিবার সময় সরকারি সংস্থাগুলোর নিয়মিত তদারকি ও দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক। ইহা ছাড়া নাগরিকদের নিরাপদ খাবার চিনিবার এবং সঠিক নিয়মে তাহা রান্না করিবার অভ্যাসও গড়িয়া তুলিতে হইবে।

খাদ্যদূষণ একটি নীরব ঘাতক। আমাদের নিজেদের এবং আমাদের শিশুদের সুস্বাস্থ্যের স্বার্থেই এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে হইবে। সরকার, উৎপাদক এবং ভোক্তাবর্গ-সবাইকে একসঙ্গে এই সংকট দূর করিতে উদ্যোগী ও সচেতন হইতে হইবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত