প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতি বছর লাখ লাখ তরুণ-তরুণীকে উচ্চশিক্ষার সনদ তুলে দিচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এই শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ কর্মসংস্থান লাভে ব্যর্থ হচ্ছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকেরও বেশি সময় পর, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন আকাশছোঁয়া, তখন শিক্ষিত বেকারের এই লাগামহীন বৃদ্ধি এক গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে রূপ নিয়েছে। শিক্ষায় রাষ্ট্রের ও জনগণের বিপুল বিনিয়োগ সত্ত্বেও, এই বিশাল জনশক্তিকে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত করতে না পারাটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক নীরব হুমকি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট বেকারত্বের সংখ্যা উদ্বেগজনক পর্যায়ে থাকলেও, এরমধ্যে সিংহভাগই হলো শিক্ষিত যুবক-যুবতী। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা গত এক দশকে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে, শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়লেও কর্মসংস্থান প্রাপ্তির নিশ্চয়তা কমছে, যা দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে চরম হতাশা সৃষ্টি করছে। দেশের অর্থনীতিকে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুবিধা দিতে হলে এই শিক্ষিত জনশক্তিকে কাজে লাগানো অপরিহার্য। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে।
বেকারত্ব বৃদ্ধির মূল কারণগুলো : কাঠামোগত দুর্বলতা শিক্ষিত বেকারত্ব বৃদ্ধির পেছনে বহুবিধ কাঠামোগত এবং নীতিগত কারণ দায়ী। প্রথম এবং প্রধান কারণটি হলো- শিক্ষা ও শিল্পের চাহিদার মধ্যে সমন্বয়হীনতা (Mismatch)। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম এখনও সনাতন ও তাত্ত্বিক বিষয়বস্তুভিত্তিক। এখানে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় আধুনিক দক্ষতা, যেমন- ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ডিজিটাল মার্কেটিং, উন্নত কারিগরি দক্ষতা বা কার্যকরী যোগাযোগ দক্ষতা (Soft Skills) শেখার সুযোগ অপ্রতুল। ফলে শিক্ষার্থীরা যখন ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছে, তখন তাদের কাজের জন্য প্রস্তুত করতে নতুন করে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ না হওয়ায় শিক্ষিত তরুণরা চাকরি পেলেও প্রত্যাশিত বেতন বা পদে কাজ করতে পারছে না।
দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি (Jobless Growth)। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল হলেও, এই প্রবৃদ্ধি শিল্প বা সেবা খাতে পর্যাপ্ত নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অটোমেশন এবং প্রযুক্তির কারণে অনেক প্রথাগত কাজ বিলুপ্ত হচ্ছে, কিন্তু সেই হারে নতুন বা উচ্চণ্ডদক্ষতার কাজ তৈরি হচ্ছে না। বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগের অভাব, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (SME) মূলধন এবং সহায়তার ঘাটতি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে। SME খাতকে সাধারণত কর্মসংস্থান সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, বাংলাদেশে এই খাতটি প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে না।
তৃতীয়ত, সরকারি চাকরির প্রতি অতিনির্ভরতা (Dependency on Public Sector Jobs)। শিক্ষিত তরুণ সমাজের একটি বিশাল অংশ বিসিএস বা অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতির পেছনে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করে। সরকারি পদ সীমিত হলেও, সামাজিক নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত হওয়ার কারণে এই চাকরির প্রতি আকর্ষণ তীব্র। কম সংখ্যক পদের জন্য লাখ লাখ প্রার্থীর এই তীব্র প্রতিযোগিতা শুধু বেকারত্বই বাড়ায় না, বরং তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা তৈরি হতে বাধা সৃষ্টি করে। এটি একটি সামগ্রিক মানসিকতা, যেখানে প্রথাগত চাকরিই সামাজিক সাফল্যের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়।
চতুর্থত, উদ্যোক্তা সংস্কৃতির অভাব এবং আর্থিক বাধা। উচ্চশিক্ষা অর্জনের পরও আত্মকর্মসংস্থান বা ছোট ব্যবসা শুরু করার প্রবণতা শিক্ষিতদের মধ্যে কম। এর মূল কারণ হলো সহজে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, ব্যবসায়িক ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সহায়তার অভাব। তরুণদের জন্য প্রাথমিক মূলধন (Seed Capital) বা স্টার্টআপ ফান্ড সহজে পাওয়ার সুযোগ তৈরি না হওয়ায় তাদের উদ্ভাবনী ধারণাগুলো মাঝপথেই থেমে যাচ্ছে।
শিক্ষিত বেকারত্বের নেতিবাচক প্রভাব : শিক্ষিত বেকারত্বের এই হার শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি এক বহুমুখী সামাজিক ব্যাধি।
প্রথমত, এটি তরুণদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করছে। দীর্ঘকাল ধরে কাজ না পাওয়ার হতাশা, পরিবার এবং সমাজের চাপ তরুণদের মধ্যে তীব্র বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব তৈরি করছে। অনেক ক্ষেত্রে এই মানসিক চাপ তাদের অপরাধমূলক কার্যকলাপ বা মাদকাসক্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই মানবিক অপচয় জাতীয় উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা।
দ্বিতীয়ত, দেশের মেধা পাচার (Brain Drain) বাড়ছে। উচ্চশিক্ষিত এবং মেধাবী তরুণরা যখন দেখছে দেশে তাদের দক্ষতার উপযুক্ত মূল্য নেই বা কাজের সুযোগ সীমিত, তখন তারা উন্নত কর্মসংস্থান ও জীবনের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। এই মেধা পাচার দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর। রাষ্ট্রের বিনিয়োগ করা মেধা বিদেশে কাজে লাগছে, কিন্তু দেশ তার সুফল পাচ্ছে না।
তৃতীয়ত, জাতীয় অর্থনীতির ওপর চাপ। শিক্ষিত বেকারদের উৎপাদনশীলতা শূন্য হওয়ায় অর্থনীতি তার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না। একই সঙ্গে, কর্মহীন এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা দিতে গিয়ে রাষ্ট্র ও পরিবার উভয়ের ওপরই আর্থিক চাপ বাড়ছে। শিক্ষাখাতে বিপুল ব্যয় করেও যখন তা জাতীয় উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই বিনিয়োগ অকার্যকর হয়ে পড়ে।
পরিত্রাণের উপায় : নীতিগত এবং কাঠামোগত সংস্কার শিক্ষিত বেকারত্বের এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল এবং শিক্ষাবিদদের সমন্বিত ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমত, শিক্ষা সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যক্রমকে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিকীকরণ করতে হবে। প্রতিটি ডিগ্রিকে অবশ্যই প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং কার্যকর কমিউনিকেশন স্কিলসের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিবিড় সহযোগিতা (Industry-Academia Collaboration) নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে ইন্টার্নশিপ বা হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক হবে।
দ্বিতীয়ত, উদ্যোক্তা ও বেসরকারি খাতকে প্রণোদনা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করতে বিশেষ সরকারি তহবিল, সহজ শর্তে ঋণ এবং কর-ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজ করা এবং ব্যবসার ঝুঁকি কমাতে সহায়ক নীতি প্রণয়ন করা জরুরি। এটি বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গতি আনবে।
তৃতীয়ত, ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি। মাধ্যমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং দিতে হবে, যাতে তারা প্রথাগত চাকরির বাইরে ভোকেশনাল, কারিগরি বা উদ্যোক্তা হওয়ার মতো পেশা সম্পর্কে জানতে পারে।
জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ