ষোল বছর পর কারাগারের উঁচু দেয়ালের বাইরে পা রাখার পর বিডিয়ারের ইঞ্জিনিয়ার কোরের সদস্য মুজাফফর হোসেন দেখতে পান পরিবারের স্বজনরা ফুল হাতে অপেক্ষা করে আছেন কেবল তার জন্য।
এরপর মুজাফফর যখন নাতিদের জড়িয়ে ধরেন, তৈরি হয় আবেগমাখা এক পরিবেশ। মুজাফফরের মত ১২৬ জন বিডিআর জওয়ান গতকাল বৃহস্পতিবার গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এই সদস্যরা হত্যা মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলার কারণে কারাগারে আটকে ছিলেন প্রায় ১৬ বছর ধরে। গত রোববার ঢাকার বিশেষ ট্রাইবুনাল-২ এর বিচারক মো. ইব্রাহিম মিয়া বিস্ফোরক আইনের মামলায় তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। এরপর গত মঙ্গলবার জামিনপ্রাপ্ত ১৭৮ জনের নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তাদের জামিননামা দাখিল করা হয় বুধবার। এরপর তাদের জামিন সংক্রান্ত নথিপত্র কারাগারে গেলে শুরু হয় মুক্তির প্রস্তুতি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার মধ্যে তারা মুক্তি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল্লাহ আল মামুন। এর মধ্যে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১ থেকে ২৪ জন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ থেকে ৮৯ জন এবং কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৩ জন মুক্তি পেয়েছেন। জামিনে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের ঘরে ফিরিয়ে নিতে কারাফটকে সকাল থেকে স্বজনরা আসতে শুরু করেন। বেলা বাড়লে সেই ভিড় বাড়তে থাকে। অনেকে সেখানে মিষ্টি ও ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন প্রিয়জনের জন্য। বিডিআরের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডাইরেক্টর হাফিজুর রহমান কারাবন্দি ছিলেন বিস্ফোরক মামলার। মুক্তি পেয়ে তিনি কারাফটকের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তার স্ত্রীর জন্য । হাফিজুর বলেন, ১৬ বছর আমরা পরাধীন ছিলাম। ছাত্র জনতা জাগ্রত হয়ে আমাদের মুক্ত করেছে। জীবনের সব কিছু হারিয়েছি। আমার ওয়াইফ অসুস্থ, তিনি আমাকে নেওয়ার জন্য রওনা হয়েছেন বগুড়া থেকে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি। বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে যায় ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের। অন্যদিকে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাই কোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। হাই কোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাই কোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুনঃতদন্তের দাবি জোরালো হয়। এরপর ওই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তে গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করে দেয় সরকার। কমিশনকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেয়া হয়েছে।