দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তির অন্যতম বিমান। আর সেই বিমান ও বিমানবন্দর নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে একটি কুচক্রিমহল। ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দফায় দফায় বোমা হামলার হুমকি দিয়েছে। এসব হুমকির বার্তা ভুয়া প্রমাণিত হলেও বসে নেই বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বোমা হামলার হুমকির বার্তাকারী শনাক্তকরণে কাজ করছে বেবিচক।
জানা গেছে, গত বুধবার সকালে পাকিস্তানের একটি নম্বর থেকে ইতালি থেকে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বিস্ফোরক থাকার তথ্য দেয়া হয়। একই দিনে রাত ১১টায় মালয়েশিয়ার একটি নম্বর থেকে বিমানবন্দরের এপিবিএনের ডিউটি অফিসারের হোয়াটসঅ্যাপে বোমা হামলার হুমকি সংবলিত বার্তা দেয়া হয়। বিমানবন্দরে বোমার হুমকির পরে তল্লাশির পাশাপাশি হুমকিদাতা শনাক্তে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, তিনি তো হুমকি দেননি, তথ্য দিয়েছেন। তবে যে কেউ বাংলাদেশে বসেও পাকিস্তানি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর ব্যবহার করতে পারেন। ওই তথ্যদাতা একটি লাগেজের ছবিও পাঠিয়েছেন, যে ধরনের লাগেজে বোমাটি থাকতে পারে বলে তার ভাষ্য। পরে আমরা খবর পেয়ে আমাদের প্রটোকল অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। সকালে অনেকগুলো ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা ছিল। আমরা অন্য সব ফ্লাইট আগে নামিয়ে দিই। ওই এয়ারক্রাফটের ল্যান্ডিংয়ের পর একটু দূরে থার্ড টার্মিনালের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়; যার কারণে এয়ারপোর্টের স্বাভাবিক কার্যক্রমে কোনো ছন্দপতন হয়নি।
তিনি আরো বলেন, দুটো সন্দেহভাজন লাগেজকে আলাদা করা হয়, সেগুলো খুলে পরীক্ষা করেও কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর এয়ারক্রাফটের কার্গো থেকে প্যালেটগুলো নামিয়ে একটা একটা করে তল্লাশি চালানো হয়। বিমান বাহিনী, পুলিশ, র্যাব, আনসারসহ সব সংস্থার সদস্যরা এই কার্যক্রমে অংশ নেন। পুলিশের কুকুরগুলোকে কাজে লাগানো হয়।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মাদ কামরুল ইসলাম জানান, বোমার থ্রেট পেলেও বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। একটি অপরিচিত হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আমরা আবারও আরেকটি সম্ভাব্য হুমকির বার্তা পেয়েছি। এরপর থেকেই নির্ধারিত প্রোটোকল অনুযায়ী বিমানবন্দরে দায়িত্বরত সব বাহিনীর সমন্বয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বিমানবন্দরের সব কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।
এর আগে সকালে পাকিস্তানের একটি নম্বর থেকে ইতালি থেকে ছেড়ে আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে বিস্ফোরক থাকার তথ্য দেওয়া হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-৫৩৬ ফ্লাইটে ৩৪ কেজি উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক রয়েছে। শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইটটি অবতরণের পর এগুলো বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। বার্তাটি পাওয়ার পর হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ আড়াইশ যাত্রীর নিরাপত্তায় ইতালির রোম থেকে ঢাকাগামী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিমানটিকে জরুরি অবতরণ করায়। সেই সঙ্গে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। বুধবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটে ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণের পর ২৫০ জন যাত্রী এবং ১৩ জন ক্রুকে নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এটা একটা মিথ্যা সংবাদ। কোনো কিছু তো হয়নি। মিথ্যা সংবাদ ছড়ানো হয়েছে। মিথ্যা সংবাদ ছড়ানোদের শনাক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। শনাক্ত করা গেলেই আইনের আওতায় আনা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরে বোমা হুমকির নেপথ্যে কারা রয়েছে তা খুঁজতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় দুইবার দুটি পৃথক দেশের কোড নম্বর থাকার কারণে বাড়তি সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বেবিচক সেজন্য পাকিস্তান এবং মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কর্তৃপক্ষ বোমার বার্তা দেয়া নম্বর দুটির মালিকের সন্ধান দিতে চিঠি দেবে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরপর বোমা হামলার হুমকির পর স্বাভাবিকভাবেই অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। বিমান এবং শাহজালাল বিমানবন্দর নিয়ে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ দ্য বাংলাদেশ মনিটর সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, বিশ্বের সব দেশেই বিমান ও বিমানবন্দর কেন্দ্র করে এমন ভুয়া হুমকির ঘটনা ঘটে। হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতেই এসব করা হয়। এবার ঢাকায় যেটি পরপর দুবার বার্তা দেয়া হলো, তাতে করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। যদিও আশা করছি এমন কোনো ঘটনা ঘটবে না। আর যাতে না ঘটে, সেজন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিমানবন্দর সেফ ঘোষণা করতে হবে। যারা এমন বার্তা দিয়েছে, তাদের অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে। আর এ জন্যে পাকিস্তান আর মলয়েশিয়া সিভিল অ্যাভিয়েশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আইটির যুগে এটা সম্ভব।
তিনি বলেন, বোমা হুমকির বিষয়টি আমাদের সতর্কবার্তা হিসেবেই মেনে নিতে হবে। নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। যেখানে শৈথিল্য আছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভবিষ্যতে এমন কোনো ঘটনা ঘটবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বিমানবন্দরে দীর্ঘদিন দাত্বি পালনকারী পুলিশের কয়েকজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুই দফায় বোমা হামলার হুমকি আসায় বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দেশের ভেতরে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে এসব হুমকি দেয়া হতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এ বার্তার পেছনে চোরাকারবারীদের হাত থাকার খাত নয়। চোরাচালান চক্রের সদস্যরা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে এমন বার্তা দেবে না। কারণ সেক্ষেত্রে অতি দ্রুত বিমানবন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এতে উল্টো চোরাচালান চক্রের সদস্যদের সমস্যায় পড়তে হয়। তারা অবৈধ মালামাল বের করতে অসুবিধায় পড়ে যায়। তাই মনে হচ্ছে, কেউ ইচ্ছে করে এমন বার্তা ছড়িয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে।