ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাজনীতিতে উত্তাপ

দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ চায় বিএনপি

দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ চায় বিএনপি

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা বিষয় আলোচনায় থাকলেও সম্প্রতি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য এবং সরকারের এক উপদেষ্টার পল্টা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। বিএনপির নেতাকর্মীদের ভাষ্যমতে, যে কোনো নতুন দল এলে নেতারা স্বাগত জানাবেন। কিন্তু সরকারের ‘আনুকূল্যে’ কোনো দল গঠন হলে তাতে আপত্তি থাকবে। এসবের পেছনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রলম্বিত করার যোগসূত্রও থাকতে পারে বলে তারা ভাবছেন। এছাড়া ইস্যুগুলো যারা সামনে আনার চেষ্টা করছেন বিএনপির সন্দেহ মূলত তাদের ঘিরে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং নতুন দল গঠনের বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে ব্যাখ্যা চাইবে বিএনপি। পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত সংলাপের উপরও জোর দিচ্ছেন দলের নেতারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিএনপি শুরু থেকেই এ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে বলে মনে করেন নেতারা। তারা কখনোই বলেনি সংস্কার চায় না। বিএনপি বলেছে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন, যা এখন সব রাজনৈতিক দলও চাইছে। কিন্তু বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেক ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রস্তাব, এতদিন পর গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ এবং নতুন দল গঠন- এসব একই সূত্রে গাঁথা বলে নেতারা মনে করছেন। এর পেছনে তারা নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা দেখছেন। কাজেই তারা দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ চান। দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ না দিলে কর্মসূচি দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। নেতাদের মতে, দ্রুত নির্বাচন না হলে সংকট আরো বাড়বে। ফ্যাসিবাদের পতন হলেও দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এর বাইরেও দেশে বিতর্ক সৃষ্টির নানা চেষ্টা আছে। এর আগে সংবিধান বাতিল করার দাবি এসেছে। কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছে। এর পরপরই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে এটিও এক ধরনের বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নতুন দল গঠন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব সঠিক কথাই বলেছেন। সরকারের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক দল গঠন হবে সরকারের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে মানুষের মনে সন্দেহ জাগবে। নির্বাচনের দিনক্ষণ যত সামনে আসবে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের অবস্থান ততই পরিষ্কার হবে। কাজেই রাজনৈতিক বিভেদ আরো বাড়ার আগেই প্রয়োজন সমস্যা সমাধানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা এবং তা দ্রুতই ব্যবস্থা করা। বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই সরকার যদি পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। এর একদিন পর গত বৃহস্পতিবার আরো কড়া অবস্থানে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বেশ কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা পালন করতে পারছে না। বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্যে কঠোর সমালোচনা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটি এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।’ বক্তব্য দুটি ঘিরে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে সমসাময়িক অনেক বিষয়ে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশকিছু কর্মকাণ্ড দলটির মধ্যে শঙ্কার কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবির পর ৭২-এর সংবিধান বাতিলের দাবি- দুটিই উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করছে বিএনপি। পাশাপাশি এও মনে করা হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা গেলে পরবর্তীকালে সুযোগ পেলে বিএনপিকেও নিষিদ্ধের দাবি তোলা হতে পারে। সেই আয়োজনও দেখতে পাচ্ছে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পক্ষে যা কিছু হয়েছে, এগুলোর কোনোটিকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বা সংগঠন অথবা ব্যক্তির পক্ষে পথ চলা সম্ভব নয়। যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করবে তাদের নিয়েই পথ চলবে বিএনপি।

নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিএনপিকে টার্গেট করেই ষড়যন্ত্র চলছে। সাম্প্রতিক ঘটনা যার বড় প্রমাণ। সামনে এসব আরো দেখা যাবে। এর পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের ইন্ধন রয়েছে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করছেন। নেতারা আরো বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের কথা টেনে আরো সন্দেহ বাড়িয়েছেন। কেন বললেন তা বোঝার জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনা চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার বিএনপি। প্রতিটি নেতাণ্ডকর্মী থেকে শুরু করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের নির্মম রোষানলে পড়েছিলেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বিএনপির জন্মই হয়েছে সংস্কারের জন্য। বিএনপির জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত সংস্কার হয়েছে। বাংলাদেশের যত ধরনের সংস্কার হয়েছে, সেটির ৯০ শতাংশ সংস্কার করেছে বিএনপি। কিন্তু এখন আমাদের অনেকে সংস্কারের সবক দিচ্ছে। ৬ বছর আগে খালেদা জিয়া ভিশন টুয়েন্টি-থার্টির মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলেছেন যে, দুইবারের অধিক কেউ প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবে না, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য। শেখ হাসিনা-পরবর্তী যে বাংলাদেশ হবে এটাকে মাথায় রেখে খালেদা জিয়া কথাগুলো বলেছেন। এই সংস্কারগুলো দরকার হবে আগামীর বাংলাদেশে। তিনি আরো বলেন, আজকে তারা সেই কথাগুলো আমাদের বলছে। তারা আবার আমাদের কথাগুলোই বলছে। আবার সংস্কারের সবক দিচ্ছে। এর থেকে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। তিনি আরো বলেন, অনির্বাচিত সরকার যত বেশি দেশ পরিচালনা করবে, তত বেশি গণবিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত আসতে থাকবে। সেজন্য নির্বাচনকে বাদ দিয়ে কোনো গণতন্ত্র আসবে না। স্বাধীনতা পেয়ে অনেকে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছেন বলে দাবি করেছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। তিনি বলেন, কেউ, কেউ বলছে বিএনপি আবারো ১/১১ (ওয়ান-ইলেভেন) আনার পাঁয়তারা করছে। ১/১১-এর ভয়াবহ পরিণতির শিকার বিএনপির চেয়ে কেউ হয়নি। গত শুক্রবার বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের নিচতলায় আরাফাত রহমান কোকোর দশম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে ১/১১ সরকারের নির্যাতন থেকে দলের এমন কোনো নেতাকর্মী রেহাই পায়নি। এভাবে কথা বললে দেশের গণতন্ত্রের চেহারা কেউ দেখতে পারবেন না। একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে। ‘গাছে কাঁঠাল গোফে তেল’ তারা এখন সুযোগ পেলেই বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, রাজনীতিবিদরা কোন বিষয়ে কথা বলবেন, কোনটাকে সমর্থন করবেন আর কোনটাকে নয়, এটা কি উপদেষ্টারা শেখাবেন? গত শুক্রবার বনানী করবস্থানে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর দশম মৃত্যুবার্ষিকীতে করব জিয়ারত শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন। অন্তর্বর্তী সরকার এক-এগারোর ভয় দেখিয়ে সমর্থন নিতে চায় মন্তব্য করে রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘স্পষ্ট করে বলতে চাই, ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। সবার মতামতের ভিত্তিতে স্বচ্ছ নির্বাচন চায় জনগণ, যা শেখ হাসিনা হতে দেয়নি।’ গতকাল শনিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে এ কথা বলেন তিনি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত