ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করায় বহু মানুষকে আয়নাঘরে আটকে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার ঢাকার আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় অবস্থিত তিনটি আয়নাঘরের সন্ধান মিলেছে। রাজধানীর কচুক্ষেতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং উত্তরা ও আগারগাঁওয়ে র্যাবের বহুল আলোচিত আয়নাঘর বা গোপন বন্দিশালাগুলো পরিদর্শন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ভুক্তভোগী, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য এবং সাংবাদিকরা। এসব আয়নাঘরে দিনের বেলাতেও আলো প্রবেশের সুযোগ নেই।
সরেজমিন আয়নাঘর পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর কচুক্ষেতে ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের ভেতরে দোতলায় ২২টি টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র), গোপন বন্দিশালায় ইলেকট্রিক চেয়ার, গোপন বন্দিশালাগুলোর দেয়ালে লেখাচিত্র মুছে দেয়া হয়েছে, আবার কোথাও কোথাও দেয়াল ভাঙা হয়েছে। ভাঙা দেয়াল নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে। এছাড়াও গত সরকারের সময় গোপন বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত অনেকগুলো কক্ষের আলামত ৫ আগস্টের পর নষ্ট করে ফেলা হয়। গোপন নির্যাতন কেন্দ্রের একটির দেয়ালে লেখা আছে ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন’, কিছু কক্ষের দেয়ালে ছোট ছোট দাগ কেটে রাখা হয়েছে, হয়তো কোনো বন্দি দিন বা মাসের হিসাব করার জন্য দেয়ালে দাগ কেটেছেন। একটি কক্ষের দেয়ালে ফ্যানের সঙ্গে লাগানো সিসি ক্যামেরা ছিল, সিসি ক্যামেরা দিয়ে কক্ষের ভেতরের দৃশ্য মনিটরিং করতেন। নির্যাতনের শিকার মানুষের ব্যবহারের নানা জিনিসপত্র কক্ষে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
জানা গেছে, রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সোচ্চার বা আওয়ামী লীগের বিরোধী মতের বহু মানুষকে তুলে নিয়ে বিচার বহির্ভূতভাবে ‘আয়নাঘর’ আটকে রাখা হয়। আয়নাঘরে বন্দি করে ভয়ংকর নির্যাতন চালানো হয়। অনেকেই নির্যাতন সইতে না পেরে প্রায় উন্মাদ হয়ে গেছেন। কেউ বা বরণ করেছেন মৃত্যুকে। হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই বন্দিশালা থেকে ছাড়া পেয়েছেন কয়েকজন।
ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে ৪০২ জন নিখোঁজ হয়। ২০১৪ থেকে জুলাই ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৩৪৪ জন ব্যক্তি গুমের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ৪০ জন ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, ৬৬ জনকে সরকারি হেফাজতে গ্রেপ্তার অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যমতে ২০৩ জন এখনো গুম রয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন গুম থাকার পর ফিরে আসেন, তারা গুমের ব্যাপারে মৌন অবলম্বন করেন। ধারণা করা হয় এসব মানুষদের গুম করে রাখা হয় আয়নাঘরে। আর সেই আয়নাঘরের দায়িত্বে থাকতেন আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্য। যারা পুরো বাংলাদেশে আওয়ামীবিরোধী শক্তি নির্মূল ও মানুষকে ভয়-ভীতি দেখানোর কাজে সরাসরি লিপ্ত ছিলেন। আয়নাঘরে যারা বন্দি থেকেছেন তাদের মধ্যে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ মোবাশার হাসান, সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ কুমার রায়।
স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড ও ভারতীয় স্বার্থরক্ষার বিষয়ে সমালোচনা করায় মারুফ জামানকে আয়নাঘরে বন্দি করা হয়েছিল। সেই বিষয়ে মারুফ জামান বলেন, সামরিক ঘাঁটিতে বন্দি অবস্থায় ছিলেন তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কেননা, ভোরবেলায় সেখানে কুচকাওয়াজের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। এছাড়াও আয়নাঘর থেকে সম্প্রতি ছাড়া পান বাংলাদেশি ব্যারিস্টার এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে মীর আহমদ বিন কাসেম, সাবেক সামরিক জেনারেল এবং জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযমের ছেলে আবদুল্লাহিল আমান আজমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমা। আয়নাঘরে আটকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের নিন্দা প্রস্তাব জানায়।
গত শুক্রবার বহুল আলোচিত ‘আয়নাঘর উন্মোচন’ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবিতে ঢাকার উত্তরায় র্যাব-১ কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ‘কাউন্সিল অ্যাগেইন্সট ইনজাস্টিস’ (সিএআই) নামে একটি সংগঠন। র্যাবের দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার; গুমের শিকার ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ। একইসঙ্গে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি তোলেন তারা।
প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেয়া, গোপন বন্দিশালা বন্ধ করা এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জোরালোভাবে উঠেছে। এমন একটা প্রেক্ষাপটে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আয়নাঘর পরিদর্শন করেছেন।