২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তৃতা বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে সম্প্রচার করা হয়। বাজেট বক্তৃতার শুরুতে অর্থ উপদেষ্টা একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহিদদের স্মরণ করেন। একইসঙ্গে তিনি স্মরণ করেন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় শহিদদের। তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে তিনি বলেন, ‘২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের এক ক্রান্তিলগ্নে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমাদের ওপর বর্তায় বিগত সরকারের রেখে যাওয়া প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার এবং নৈরাজ্য দূর করে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার কঠিন কাজটি। আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার এরইমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান এরপর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শিগগিরই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তার বাজেট বক্তৃতায় বাংলাদেশকে দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বনমুক্ত জাতিতে রূপান্তরিত করার ওপর জোর দিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টার আশা, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনায় তৈরি’ এ বাজেট ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই সমাজ গড়ে তোলার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং একটি উন্নত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সরকার যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তার মূল লক্ষ্য হলো শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নির্গমনকারী একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ‘এর মাধ্যমে, আমরা আমাদের জনগণের জীবনমানের গভীর রূপান্তর আনতে এবং বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে চাই। ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল আকাঙ্ক্ষা এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি স্থাপন করেছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর, বাসযোগ্য স্বদেশ রেখে যাওয়ার এবং আমাদের জনগণের জীবনে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ঢেউ আনার প্রত্যাশা করি। এই দৃষ্টিভঙ্গি মাথায় রেখে আমরা এ বছরের বাজেট প্রস্তাব রাখার চেষ্টা করেছি।’
এবার গত অর্থবছরের চেয়ে বাজেটের আকার কমেছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এবারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটিও গত বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জোগান দেবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ ভাগ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঘাটতির ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেটে পরিচালন ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কমেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ছিল ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এবার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর ৫৭ ভাগই যাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভর্তুকি, প্রণোদনা ও ঋণ পরিশোধে। নতুন বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ১০ থেকে ২০ ভাগ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের বাজেটে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কর কমতে পারে ২ দশমিক ৫ ভাগ। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের কর নামবে ২০ শতাংশে। তবে অপরিবর্তিত থাকছে পুঁজিবাজারের বাইরের প্রতিষ্ঠানের করহার। এসব প্রতিষ্ঠানকে আগের মতোই ২৭ দশমিক ৫ ভাগ কর দিতে হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে ব্রোকারেজ হাউসের সিকিউরিটিজ লেনদেন কর শূন্য দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে ২৭ দশমিক ৫। গতবারের মতো এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে। এছাড়া, অপ্রদর্শিত অর্থ প্রতিরোধে, প্রকৃত মূল্যে রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিতে করহার এলাকাভেদে ৮, ৬ ও ৪ শতাংশের পরিবর্তে কমে হচ্ছে যথাক্রমে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ। এবারের বাজেটে জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছর জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে অর্জিত হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ ভাগ। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। গত এপ্রিলের হিসেবে দেশের বর্তমান সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
করমুক্ত ব্যক্তির আয়সীমা : এবারের বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। অর্থাৎ বছরে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিকে আয়কর দিতে হবে। নারী ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা। আর প্রতিবন্ধীদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
এছাড়া গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ টাকা। এবারের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমায় নতুন যুক্ত হয়েছেন ‘জুলাই যোদ্ধারা’। নতুন অর্থবছরে তাদের করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকার প্রায় ৯৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে পারে, যা মোট বাজেটের ১২ দশমিক ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৯০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা, যা ছিল মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
দাম বাড়ছে যেসব পণ্য ও সেবার : এবারের বাজেটে বেশ কিছু পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে কনভেনশন হল, নির্মাণ খাত, সেল্ফ কপি পেপার, কোটেড পেপার, ই-কর্মাস কমিশন। এছাড়াও প্লাস্টিকসামগ্রী, গৃহস্থালিসামগ্রী, টয়লেটসামগ্রী, কটন সুতা, কৃত্রিম সুতা, ব্লেড, জয়েন্ট, নাট, বোল্ট, ইলেকট্রিক লাইন হার্ডওয়্যার ও সিগারেট কিনতে ভোক্তাদের আগের চেয়ে বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হবে।
দাম বাড়ছে ওটিটি সেবা, এলইডি লাইট, আমদানিকৃত লিফট, সিফুড, নারিকেল তেল, স্যালমন ফিস, আমদানিকৃত মাংস, আমদানিকৃত টুনা, লবঙ্গ, এলাচ, জিরা, দারচিনি, মাখন, দুগ্ধজাত পণ্য, চিজ, বিদেশি সবজি, কাজু বাদাম, শুকনা ফল, আপেল ও নাশপাতির।
আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হবে রড, কফি, চকলেট, শিশু খাদ্য, পাস্তা, বিস্কুট, চিপস, জ্যামণ্ডজেলি, জুস ও সস। এছাড়াও দাম বাড়ছে দেশি তৈরি মোবাইল ফোন, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার ও মিক্সারের। মার্বেল- গ্রানাইট, অ্যালকোহল, ফুড সাপ্লিমেন্ট, তামাক জাতীয় পণ্য, বিদেশি লবণ, আইসক্রিম, বার্নিশ, সুগন্ধি, এলপিজি সিলিন্ডার, অটোরিকশা, প্রসাধনী, সাবান, ডিটারজেন্টের জন্য বাড়তি মূল্য পরিশোধ করতে হবে ভোক্তাকে।
দাম কমছে যেসব পণ্য ও সেবার : এবার বেশকিছু পণ্য ও সেবার দাম আগের বছরের তুলনায় কমছে। এগুলো হলো ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ, শিল্পের কাঁচামাল, এলএনজি, সিলিন্ডার, দেশি স্যানিটারি ন্যাপকিন, দেশি ডায়াপার, প্যাকেটকৃত তরল দুধ ও বলপয়েন্ট, ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটর, রেন্ট, হাসপাতালের বেড, ওষুধের কাঁচামাল, হাসপাতালের যন্ত্রাংশ, কোল্ড স্টোরেজ, এলপিজি সিলিন্ডার, ব্যাটারি, কীটনাশক, ফ্রুট ব্যাগ, টায়ার ও সার।
আরও যেসব খাতে করহার কমছে : রিসাইক্লিং শিল্পে কাঁচামাল সরবরাহে কর ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ। গ্যাস বিতরণ কোম্পানির উৎসেকর ২ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ, জ্বালানি তেল রিফাইনারি কোম্পানির উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে ১ দশমিক ৫ এবং ইন্টারনেট সেবার উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে ৫ শতাংশ। এছাড়া বিদ্যুৎ কেনার উৎসে কর ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হচ্ছে ৪ শতাংশ, সিগারেট কোম্পানির বিক্রির অগ্রিমকর ৩ থেকে বেড়ে হচ্ছে ৫ শতাংশ, ব্যক্তি করদাতার টার্নওভারের করমুক্ত সীমা ৩ কোটি থেকে বেড়ে হচ্ছে ৪ কোটি হচ্ছে এবং মোবাইল অপারেটরদের টার্নওভার কর ২ শতাংশ থেকে কমে হচ্ছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে মানুষের স্বস্তি, কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবনা : প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সাধারণ মানুষকে স্বস্তি প্রদান, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছে।
বাজেট ঘোষণায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিয়ে দেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে একটি উন্নত সমাজ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমরা যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করেছি, তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বনভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ। যার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে এ দেশের মানুষের জীবনমানের এবং বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি মিলবে। যে স্বপ্নকে ধারণ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ভিত রচিত হয়েছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে আগামী প্রজন্মের জন্য আমরা একটি সুন্দর, বাসযোগ্য আবাসস্থল রেখে যেতে চাই। জনগণের জীবনযাত্রায় নিয়ে আসতে চাই এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের ঢেউ। আমরা সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবারের বাজেট সাজাবার চেষ্টা করেছি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, আমাদের এবারের বাজেট কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী। আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। অথচ তুলনীয় অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। রাজস্ব খাতকে আরও গতিশীল করতে এবং রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে এরইমধ্যে আমরা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। অটোমেটেড ব্যবস্থার মাধ্যমে আয়কর রিটার্ন দাখিল সহজ করা হয়েছে, কর আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন কর অফিস স্থাপন করা হচ্ছে এবং কর আহরণের মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি রাজস্ব কৌশল তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া, কর ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর এবং কর আদায়ের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে রাজস্ব নীতি থেকে পৃথক করার লক্ষ্যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, বিগত সরকারের সময়ে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট এবং দুর্নীতির ফলে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেলেও তা বারবার পুনঃতফশিলিকরণের মাধ্যমে আর্থিক খাতের প্রকৃত অবস্থা গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমরা আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী লোন লিজ ক্লাসিফিকেশন ও প্রভিশনিং ব্যবস্থা অবলম্বন করেছি। ফলে এ খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের জুন মাসের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ খাতের প্রকৃত চিত্র উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে এসেট কোয়ালিটি রিভিউয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা নিরূপণের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে। তাই প্রথাগত ভৌত অবকাঠামো তৈরির খতিয়ান তুলে ধরার পরিবর্তে আমরা এবারের বাজেটে প্রাধান্য দিয়েছি মানুষকে। মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, জীবিকার নিরাপত্তা এবং বৈষম্যহীন পরিবেশ- এ অত্যাবশ্যক উপাদানগুলো ছাড়া যে কোনো রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে পড়ে, দুর্বল হয় সমাজের ভিত। এবারের বাজেটে তাই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত যেসব সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে তার সুবিধা ভোগ এবং যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে তা মোকাবিলা করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার দিকেও মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৫.৫ শতাংশ নির্ধারণ : অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫.৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বা ৫.২৫ শতাংশ থেকে কিছুটা বেশি। গতকাল সোমবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট উপস্থাপন করেন। সেই ভাষণে তিনি প্রবৃদ্ধির এই লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা দেন। যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীগুলোর পূর্বাভাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে থাকতে পারে বলে প্রক্ষেপণ রয়েছে।
চলতি জুনেই মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে: অর্থ উপদেষ্টা : মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে সরকারের ধারাবাহিক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের আগস্ট মাসে আমাদের সরকার যখন দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করে তখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বিগত মাসগুলোতে আমরা ধারাবাহিকভাবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছি। এর ফলে নীতি সুদের হার ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রানীতির আওতায় গৃহীত কার্যক্রমকে সহায়তা করতে সংকোচনমূলক রাজস্বনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে আনায় সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব এরইমধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে শুরু করেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০.৮৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আশার কথা হলো এবারের রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে স্থিতিশীল ছিল। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এই জুন মাসেই পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের কোঠায় নেমে আসবে। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে। মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকা জরুরি উল্লেখ করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা অত্যাবশ্যক। প্রবাস আয়ের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হওয়ায় এবং রপ্তানি স্থিতিশীল থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এপ্রিল মাসে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে আমরা বিগত ১৪ মে তারিখে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি।
করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি : উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। সাধারণ করদাতাদের জন্য অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগের মতোই বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রেখেছেন। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ শতাংশ হারে একটি কর স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া স্তরেও পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে।
এর পাশাপাশি ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে পরের এক অর্থবছর পর্যন্ত করমুক্ত আয়সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন অর্থ উপদেষ্টা। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা হবে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কর স্তরের পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাব অনুসারে, ৫, ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ শতাংশ করহারের পরে উচ্চস্তরে আরেকটি করহার এসেছে। হিসাব করে দেখা গেছে, বছরে আয় সাড়ে ৩৮ লাখ টাকার বেশি হলে ওই করদাতাকে বাকি অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।
নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রথম সাড়ে তিন লাখ টাকার পরে প্রথম এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকার জন্য ২০ শতাংশ ও পরবর্তী ২০ লাখ টাকা আয়ের জন্য ২৫ শতাংশ এবং বাকি অর্থের ওপর ৩০ শতাংশ হারে কর বসবে।
এছাড়া নারী করদাতা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা হলো চার লাখ টাকা। তৃতীয় লিঙ্গের করদাতা ও প্রতিবন্ধী স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা হবে পৌনে পাঁচ লাখ টাকা। গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা করদাতার করমুক্ত আয়ের সীমা পাঁচ লাখ টাকা হবে। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মাতা-পিতা বা আইনানুগ অভিভাবকের প্রত্যেক সন্তান বা পোষ্যের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা আরও ৫০ হাজার টাকা বেশি হবে।
গেজেটভুক্ত জুলাইযোদ্ধা করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে : গেজেটভুক্ত জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর আহত জুলাইযোদ্ধা করদাতাদের জন্য ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন করদাতাদের জন্য ন্যূনতম কর এক হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। করমুক্ত আয়সীমা পার হলেই এক হাজার টাকা কর দিলে হবে।
পাশাপাশি প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। সাধারণ করদাতাদের জন্য অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগের মতোই বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা অপরিবর্তিত রেখেছেন। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ৩০ শতাংশ হারে একটি কর স্তর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া স্তরেও পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৬-২৭ অর্থবছর থেকে পরের এক অর্থবছর পর্যন্ত করমুক্ত আয়সীমা ২৫ হাজার টাকা বাড়ানোর ঘোষণাও দিয়ে রেখেছেন অর্থ উপদেষ্টা। ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা হবে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। কর স্তরের পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবার ও আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব : ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণ, গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবার এবং আহত ছাত্র-জনতার পুনর্বাসনসহ গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ ও চেতনাকে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে এরইমধ্যে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং গণ ভবনকে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শিগগিই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহিদদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। এছাড়া, তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবার এবং আহতদের জন্য ৪০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব বিবেচনায় আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করছি।