ঢাকা সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ভিন্ন ভিন্ন মতকে এক সুতোয় আনার চেষ্টা

ভিন্ন ভিন্ন মতকে এক সুতোয় আনার চেষ্টা

ত্রায়োদশ জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনব্যবস্থাসহ ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক শেষ হয়েছে। গতকাল ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ ২৬টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ নেতা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। প্রত্যেকটি দলের প্রতিনিধিরা ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকশ করেন। বৈঠক শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা আশা করব, খুব দ্রুত এই সংস্কারের বিষয়ে ন্যূনতম যে ঐকমত্য তৈরি হবে, সেটার ওপর ভিত্তি করে অতি দ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেটাই আমাদের প্রত্যাশা।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে হতে হবে বলে আবার বিএনপির অবস্থানের কথা বৈঠকে তারা তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলেছি জাতীয় নির্বাচন আগে হতে হবে। তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন।

মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম বৈঠক করলেন। এই বৈঠকে তিনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে কথা বলেছেন। দলগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, সংস্কারের যে প্রতিবেদনগুলো বিভিন্ন কমিশন জমা দিয়েছে, সেগুলোর ওপর আলাপ-আলোচনা হবে। দলগুলো এ নিয়ে কমিশনগুলোর সঙ্গে কথা বলবে। এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেটাই মূল কথা। আজ প্রাথমিক আলোচনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন কথা বলেছে।

তিনি বলেন, প্রথম বৈঠকটি ছিল মূলত পরিচিতিমূলক, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজস্ব মতামত উপস্থাপন করেছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ও গঠনমূলক আলোচনা হয়নি। প্রয়োজনীয় সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন যে সংস্কারের যে রিপোর্টগুলো প্রত্যেকটি কমিশন দিলো, সেগুলোর ওপর আলাপ-আলোচনা হবে। দলগুলো এটা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে কথা বলবে। একটা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সেজন্য আজকে প্রাথমিক আলোচনা, সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত দিয়েছেন।

এদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সব পজিটিভ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবে জামায়াত।

মোহাম্মদ তাহের বলেন, সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত ব্যবস্থার পরে যথা শিগগির নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে আমরা আহ্বান জানিয়েছি। আজকে খসড়া আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে আবার ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় হবে, সেখানে আমাদের মূল প্রতিক্রিয়া জানাবো।

নির্বাচনের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা বলেছি আগে সংস্কার বিষয়গুলো আসুক। আমরা ঐকমত্য হই। এরপর নির্বাচনের বিষয় আসবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। আমরা দেখি সেটা কতটুকু এগোয়।

আলোচনা বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। বৈঠক শেষে পার্থ বলেন, বৈঠকে ছোট ছোট অ্যাডভাইস দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কবে হবে, কোন কোন দল তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায়। আমরা বলেছি যে, আমরা আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চাই না।

তিনি বলেন, সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়ন পরিষদে একটা মারামারি হওয়ার শঙ্কা আছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। গ্রাউন্ড রিয়েলিটি আলাদা। আওয়ামী লীগকে গ্রাউন্ড রিয়েলিটিতে অনেকে মানে না, মেনে নেবে না। এই সন্ত্রাস যেন না হয়, স্থিতিশীল যেন থাকে। কোনো ধরনের সংস্কারের জন্য যেন জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত না হয়, সে বিষয়ে আমাদের তরফ থেকে বলেছি। অনেক রাজনৈতিক দল আবার চেয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে ভালো হবে।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, এ সরকার ক্ষমতায় আছে ঠিকই, কিন্তু কর্তৃত্ব সুস্পষ্ট হয়নি। এরকম কর্তৃত্বহীন অবস্থায় যে কোনো নির্বাচন হবে বিপজ্জনক। এই সরকারের সঠিক কর্তৃত্ব এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এরকম একটা ভঙ্গুর অবস্থায় কীভাবে একটি নির্বাচন করবেন। কর্তৃত্ব এবং সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে এ নির্বাচন হতে পারে খারাপ একটা নির্বাচন।

এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে আমরা বলেছি, প্রথম সাক্ষাতে বলা হয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্যের জন্য একটি টিম গঠন করে দেন, কিন্তু সেটা করেননি, দেরি করেছেন। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি স্থানীয় কিংবা জাতীয় নির্বাচন আগে করেন, কিন্তু প্রশাসনিক কর্তৃত্ব লাগবে।

দেশের উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে অনেক জায়গা থেকে আশ্বাস পেয়েছেন, এমনটা প্রধান উপদেষ্টা জানিয়েছেন বলে মুজিবুর রহমান মঞ্জু জানান। তিনি বলেন, তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) মনে করেন, সহযোগিতা পেলে অর্থনীতি একটা পারফেক্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা পেলেও দেশ সংস্কারের জন্য সবার সহযোগিতা দরকার।

বিভিন্ন কমিশনের কাছে দেয়া প্রস্তাব সম্পর্কে মুজিবুর বলেন, পাঁচটা সংস্কার কমিশনকে তারা লিখিত প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সব দলের পক্ষ থেকে দেয়া প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো সবারই প্রস্তাব, সেগুলোর আলাদা তালিকা করতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর যে ভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে। তাহলে সময় বাঁচবে এবং দ্রুত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া যাবে বলে তিনি মনে করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে মুজিবুর বলেন, আপনাদের কোনো আলোচনায়, কোথাও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অবদান ঠাঁই পায় না। কেউ কেউ জেলে গিয়েছিলেন, নির্যাতিত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। কোনো একটা ছবিতে আপনাদের কোনো কার্যক্রমে ঠাঁই পায় না। তাহলে কীভাবে জাতীয় ঐকমত্যের জন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চান? সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা শুনলেও কতটুকু আমলে নেয়, সেটা টের পাওয়া যায় না উল্লেখ করে এবি পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, আশা করি অন্তর্বর্তী সরকার কথাগুলোকে গুরুত্ব দেবে। ঐকমত্য কমিশন ভালো কাজ করবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে বের হয়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, বৈঠকে উপস্থিত জাতীয় পর্যায়ের নেতারা বলেছেন, এ সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলের যেমন সমর্থন রয়েছে, তেমনি জনগণের বিপুল সমর্থন রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিশাল সমর্থন আছে।

সাইফুল হক বলেন, ছয়টা কমিশন অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ তৈরি করেছেন একটা রাষ্ট্র, সরকার, সংবিধানের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য। এ সুপারিশের কপি নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। জোটগুলোর সঙ্গে কথা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা পরিষ্কারভাবে বলেছেন কোনো প্রস্তাবনা ঐকমত্য কমিশনের ভিত্তিতে বা সরকারের ভিত্তিতে চাপিয়ে দেয়ার কোনো মনোভাব তাদের নেই। আলাপ-আলোচনা করে, একটি বোঝাপড়া তৈরি করে যে প্রশ্নে আমরা ঐকমত্য হতে পারব সেই ভিত্তিতে প্রফেসর আলী রিয়াজ চেষ্টা করবেন একটি জাতীয় সনদ তৈরি করার। জাতীয় সনদের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে জাতীয় নির্বাচন বা সংবিধান সংস্কার প্রশ্নে আলোচনা হবে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আরেকটা বিষয় প্রফেসর ইউনূস পরিষ্কার করে বলেছেন আজ, ভারত তাদের বাংলাদেশবিরোধী নীতিকে একটা বিপর্যয়ে ফেলেছে। সর্বশেষ ট্রাম্পের কাছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দৌড়ঝাঁপ করেছেন। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে তার কোনো নালিশ ট্রাম্প প্রশাসন আমলে নেয়নি।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ শুরুর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, তা ‘জুলাই চার্টারের’ ওপর নির্ভর করছে। জুলাই চার্টারের ওপর নির্ভর করবে, আমাদের নির্বাচনের তারিখটা কবে হবে।

‘জুলাই চার্টার’ কী, ব্যাখ্যা করে প্রেস সচিব বলেন, আমরা আশা করছি, ছয়টি সংস্কার কমিশন যে রিপোর্টগুলো দিয়েছে; সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খুভাবে পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে এই কমিশনের আলাপ হবে। আলাপের পর সব পলিটিক্যাল পার্টির ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা সবাই অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলো সাইন বা সই করবে। সেই সাইনড ডকুমেন্টটা হবে জুলাই চাটার্ড। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকে পুনর্গঠন এবং তারপরে আমরা যে রাজনৈতিক সমাধানে যাচ্ছি; কীভাবে আমাদের ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনটা হবে, সেটার জন্যই গতকাল রাজনৈতিক সংলাপের সূচনা বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।

শফিকুল আলম বলেন, আপনারা দেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে, মোস্ট লাইকলি ইলেকশনটা হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে আমরা হয়তো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারব। আর পরে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে তারা বাকিগুলো বাস্তবায়ন করবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সালাউদ্দীন আহমেদ, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন আহমেদ। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব ইউনুছ আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীসহ তিনজন, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ অন্যান্য দল ও সংগঠনের নেতারা অংশগ্রহণ করেন। এই বৈঠকে ২৬টি দল ও জোটের প্রায় ১০০ নেতা অংশ নেন।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহ-সভাপতি করা হয়েছে। কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সরফরাজ হোসেন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত