মাঠপ্রশাসনে আইনশৃঙ্খলা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ সরকারের সব ধরনের কাজ তদারকি করেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। আর বহুল প্রতীক্ষিত সেই ডিসি সম্মেলন গতকাল উদ্বোধন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলন উদ্বোধনকালে প্রধান উপদেষ্টা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা ডিসিদের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে কারো রক্তচক্ষু বা ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। কারো ধমক শুনবেন না। নিজের মতো করে যেটা আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার, সেটা করতে হবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে জেলা প্রশাসকদের সজাগ থাকার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখতে মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা আইন করে দিয়েছি, কিন্তু গ্রামেগঞ্জে পৌঁছায়নি। অথচ আমরা এখানে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছি। এই যে দূরত্ব এটা যেন না থাকে। বিনা কারণে মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছে। হয়রানি করাটাই যেন আমাদের ধর্ম। সরকার মানেই মানুষকে হয়রানি করা, এটাকে উল্টে দিতে হবে। সরকার ভিন্ন জিনিস। আপনার অধিকার পৌঁছে দেয়াই আমাদের কাজ।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, কারো রক্ত চক্ষুর কারণে, কারো ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নেই। অন্তত এই (অন্তর্বর্তী সরকারের) সময়টুকুতে। আমি নিজের মতো করে যেটাই আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার সেটা আমি করবো। সে কাজেই আমি ব্যস্ত থাকব যাতে আমি করতে পারি। সরকার মানেই হয়রানি এই ধারনা উল্টে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিনা কারণে মানুষকে হয়রানি করা হয়। হয়রানি করাটাই যেন আমাদের ধর্ম! সরকার মানেই মানুষকে হয়রানি- এটার থেকে উল্টে দাও। সরকার ভিন্ন জিনিস, আপনার অধিকার আপনার দরজায় পৌঁছে দেয়া আমাদের কাজ। এটাই যেন আমরা স্মরণ রাখি।
তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিজীবনে ডিসির চাকরি এক স্মরণীয় অধ্যায়। এ সময়ে (ডিসি থাকা অবস্থায়) তারা সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নিজেদের মতো করে কাজ করতে পারেন। তাই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পদে চাকরি করলেও অনেকেই কথা প্রসঙ্গে ডিসির স্বল্পকালীন চাকরি সময়ের কথা ঘুরেফিরে বলে থাকেন। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে তিন দিনব্যাপী ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সম্মেলন শেষ হবে ১৮ ফেব্রুয়ারি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা ও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা সরকারের সর্বোচ্চ বিবেচ্য বিষয়। এতে আমরা কতটুকু অগ্রসর হলাম, কী করণীয় তা নির্ধারণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিফল হওয়া যাবে না।
তিনি বলেন, আমরা সবাই মিলে সরকার। একেক জন ডিসি একেক জেলার দায়িত্বে থাকেন। সেখানে পুলিশ প্রশাসনের কাজ কী, সিভিলে প্রশাসনের কাজ কী- তা সবই জানা। সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা থাকলে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কী করতে হবে, উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চেইন অব কমান্ড কীভাবে যাবে, দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না, কারণ সবাই মিলে সরকার। সব নাগরিকের সুরক্ষা প্রদান ও নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব।
তিনি বলেন, নারী ও শিশুদের রক্ষা একটা বিশেষ দায়িত্ব। সংখ্যালঘুদের রক্ষা মস্ত বড় দায়িত্ব। কারণ সারা দুনিয়া সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সরকার কী ব্যবহার করছে এটা নিয়ে আমাদের ওপর নজর থাকে। প্রধান উপদেষ্টা ডিসিদের প্রাথমিক শিক্ষার ওপর নজরদারির পরামর্শ দেন। ডিসিরা সরজমিনে কিছু স্কুল পরিদর্শন ও শিক্ষকম-লীর সঙ্গে কথাবার্তা বললে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ড. ইউনূস বলেন, জন্মনিবন্ধনের কোনো মা-বাপ আছে বলে আমার মনে হয় না। নিয়ম আছে কিন্তু মা-বাপ নেই। বৃদ্ধ বয়সে কোথাও যেতে চাই, সেজন্য পাসপোর্ট লাগবে। জন্মনিবন্ধন না হলে পাসপোর্ট পাওয়া যাবে না। আবার স্বাভাবিকভাবে জন্মনিবন্ধন পাওয়া যাবে না, কিন্তু পয়সা দিলে ঠিকই চলে আসে। পয়সা দিলে যখন চলে আসে, তখন পয়সা না দিলেও চলে আসার কথা। এ সিস্টেম আমরা কেন করতে পারছি না?
ড. ইউনূস বলেন, জন্মনিবন্ধন একজন নাগরিকের জন্মগত অধিকার। যে কোনো নাগরিক যে কোনো বয়সে জন্মনিবন্ধন চাইলে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ঝামেলামুক্ত উপায়ে জন্মনিবন্ধন পাওয়ার জন্য সৃজনশীল হতে হবে, নতুন নিয়ম বের করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সভা সমিতিতে স্তুতি বাক্য অগ্রহণযোগ্য। কাউকে স্তুতি দিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। স্তুতি বাক্য পরিহার করার একটি সিদ্ধান্ত নিলাম। সভা-সমিতিতে স্তুতি বাক্য একটি অগ্রহণযোগ্য বলে চালু করব।
ডিসি সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উদ্বোধনী বক্তব্যের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, জেলা প্রশাসকদের নিজ নিজ শহরে বিশেষ বিশেষ কিছু নিদর্শন রেখে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের নামে কোথাও কোনো কিছু হবে না। এমনকি সরকারে যারা আছেন তারা কোথাও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতেও যাবেন না।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ সবার দাবি-দাওয়া মেটানো নয়, বরং একটি সুশাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ। একটি সুন্দর নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারেন। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে সামনে নির্বাচন আসছে, সেই নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু করা যায় সেটিই আমাদের সরকারের প্রধান কাজ। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসকরা সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
তিনি বলেন, আরেকটা পরামর্শ দিয়েছি, যেহেতু তারা (জেলা প্রশাসকরা) নিজ নিজ এলাকায় ছোট একটি শহরে থাকেন, সেই শহরগুলোতে আমরা ছোটবেলায় যা দেখেছি, তখনকার দিনে যারা জেলা প্রশাসক ছিলেন বা মহকুমার প্রশাসক ছিলেন তারা কিন্তু একটা কিছু (নিদর্শন) সেই শহরের জন্য রেখে যেতেন। সেটা হোক একটি সুন্দর দিঘি, স্টেডিয়াম, স্কুল বা একটি সুন্দর পার্ক।
‘আমি ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দিয়েছি আপনারা আপনাদের প্রতিটি শহরে যেখানে যে আছেন একটা কিছু আপনাদের নিদর্শন রেখে যাবেন। যেন অনেক পরেও সবাই বলতে পারে আপনি ওই শহরের প্রশাসক ছিলেন। এটি আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা থেকে বললাম।’
শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরো বলেন, আগে জেলা প্রশাসকের নামে অনেক কিছু হতো। আজকে সবকিছুই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে হয়, প্রশাসকদের নামে কিছু হয় না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যারা আছেন তাদের নামে কোথাও কোনো কিছু হবে না। আমরা কোনো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে যেতে চাই না, আমাদের একমাত্র কাজ হলো একটি সুন্দর নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া। আর স্থানীয় পর্যায়ে আগের সরকারের নেয়া জনহিতকর প্রকল্পগুলো শেষ করতে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের জন্য ডিসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।