
মাঠপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কাজের মনিটরিং বাস্তবায়নে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শেষ হয় গতকাল সোমবার। এ দিন মাঠপ্রশাসনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজ বাস্তবায়নের জন্য ডিসিদের উদ্দেশ্যে দিকনির্দেশনা বক্তব্য দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। সোমবার ডিসি সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, সারা দেশে জেলায় জেলায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা খুঁজে বের করতে ডিসিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেসব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
ফারুক ই আজম বলেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) পুনর্গঠন করা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায়ও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সে অনুযায়ী জেলায় জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই করা হবে। সেখান থেকে চিহ্নিত করা হবে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তী সময়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ সপ্তাহে বা শিগগিরই জুলাই অধিদপ্তর আত্মপ্রকাশ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের জুলাই শহীদ এবং আহতদের জুলাই যোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাম ঘোষণা করা হবে এবং সে অনুযায়ী সনদ, পরিচয়পত্র দেয়া হবে। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জুলাই যোদ্ধারা ক্যাটাগরি অনুযায়ী এককালীন ও মাসিক ভাতা পাবেন। প্রত্যেক শহীদ পরিবার ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পাবে। আহতরা পরিচয়পত্রের পাশাপাশি আজীবন ভাতা ও চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।
তিনি বলেন, তিনটি ক্যাটাগরি করা হচ্ছে। এ ক্যাটাগরির যোদ্ধারা এককালীন ৫ লাখ টাকা ও মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। বি ক্যাটাগরির যোদ্ধারা এককালীন ৩ লাখ টাকা ও মাসিক ১৫ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। পুনর্বাসন ও সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবেন সি ক্যাটাগরির যোদ্ধারা। এর পরে যে সরকার আসবে, তারাও জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা নিয়ে আসবেন। ফলে আমরা আশা করছি, জুলাই শহীদ, জুলাই যোদ্ধাদের বিষয়গুলো পরবর্তী সরকারও অগ্রাধিকারে রাখবে। ফারুক ই আজম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হওয়ায় তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রমের মালামাল এখন থেকে স্থানীয় পর্যায়ে সংগ্রহ করা হবে। দ্রুত সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছানো, বিকেন্দ্রীকরণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ডিসিদের তত্ত্বাবধানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসব মালামাল কিনবেন। প্রতি উপজেলায় এ খাতে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে মালামাল কিনবেন। বর্তমানে ত্রাণসামগ্রী কেন্দ্রীয়ভাবে কেনা হয়। এতে একই জায়গা থেকে বারবার কেনা হচ্ছে। ফারুক ই আজম বলেন, স্থানীয় পুনর্বাসন, টিআর, কাবিখা কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য ডিসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্প যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় সে জন্যও নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের। অন্যদিকে ডিসি সম্মেলনে আইএমএফ’র চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় পিছিয়ে যাচ্ছে। মার্চ মাসের পরিবর্তে চলতি বছরের জুনে চতুর্থ কিস্তির অর্থছাড়ের প্রস্তাব সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের সভায় উপস্থাপন করা হতে পারে। একই সঙ্গে তোলা হবে পঞ্চম কিস্তির অর্থছাড়ের প্রস্তাবও।
উপদেষ্টা বলেন, আমরা বলেছি যে, আমাদের কিছু কাজ আছে। আমরা অত তাড়াহুড়া করছি না। আমি একটা জিনিস বলি, আপনারা তো ভাবছেন ভিক্ষা করে নিয়ে আসি। আসলে আনতে হয় অনেক শর্ত মেনে এবং আমাদের নিজস্ব তাগিদে। কিছু শর্ত আছে যেগুলো বললেই আমরা পালন করব তা নয়। এখন আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি ভালো। চলতি হিসাব, আর্থিক হিসাব ও প্রবাসী আয় ভালো। আমরা মরিয়া হয়ে উঠছি না। আগামী মার্চে আইএমএফ পর্ষদে প্রস্তাব উঠছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মার্চে না, আমরা বলছি একটু অপেক্ষা করব। আগামী জুনে চতুর্থ ও পঞ্চমণ্ড এই দুই কিস্তির প্রস্তাব একসঙ্গে উঠবে।
চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের প্রস্তাব প্রথম দফায় গত ৫ ফেব্রুয়ারি সংস্থার নির্বাহী পর্ষদের সভায় উপস্থাপনের কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ১২ মার্চ করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে তা আরো পিছিয়ে জুনে নিয়ে যাওয়া হলো। বোর্ড অনুমোদন করলে তার কয়েক দিন পর দুই কিস্তির অর্থ একসঙ্গে ছাড় হতে পারে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ইফাদ বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে বড় অবদান রাখছে। আমাদের কৃষি খাত, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে যে উন্নয়ন দেখেন, সেটা তাদের জন্য হয়েছে। তা না হলে আমরা ১৭ কোটি লোককে খাওয়াতে পারতাম না। আমরা তাদের বলেছি এসব খাতে আরো বেশি অর্থায়ন করতে। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত অধিবেশন শেষে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বাসাবাড়ি, মার্কেট, মসজিদসহ সরকারি-বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি চালানো যাবে না। ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এসি চালানো হলে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। দ্বিতীয় দিনের ডিসি সম্মেলন শেষে ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, মার্চের মধ্যেই সারা দেশে ই-নামজারি (মিউটেশন), ভূমি উন্নয়ন কর ও খতিয়ানের মতো অনলাইন সেবাগুলো ‘ইউজার ফ্রেন্ডলি’ হবে। তিনি বলেন, সনাতনী ওইসব সেবা থেকে এখন আমরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে যাচ্ছি, এই ট্রানজেকশনটার ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে মানুষের এসব অসুবিধা দূর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা চান, ভূমি ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে আসুক। বর্তমানে আমরা ড্রোনের মাধ্যমে জরিপ কাজ পরিচালনা করছি। তিনি বলেন, শিগগির আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবে। আমরা এসব খাতে প্রশিক্ষিত জনবল ও কোম্পানিগুলোর সহায়তা পেতে শুরু করেছি। আশা করছি, সেদিন বেশি দূরে না যে, সারা দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালের আওতায় আসবে। এখন ই-নামজারি করা যাচ্ছে। জানুয়ারি পর্যন্ত একটু সমস্যা থাকলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে সেটা নেই। ক্রমান্বয়ে এই সমস্যা আরো কমে আসবে। আমাদের কাছে প্রচুর লোক আবেদন করেছে। আমরা যখন ডিজিটাল মাধ্যমে যাই তখন সারা দেশে সাড়ে ৪ লাখের মতো আবেদন পেন্ডিং ছিল। সেটা এখন কমে এসেছে। দিন দিন এটা আরো কমে যাবে। তখন মানুষের হয়রানিও কমে যাবে। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য আগামী ১০ মার্চের মধ্যে এটা করে ফেলব। আশা করছি তার আগেই মানুষ সেবাগুলো ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারবে। আর পর্চার বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। ১০ মার্চের আগে কি পেন্ডিং আবেদনগুলো শেষ হয়ে যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, আবেদন প্রক্রিয়া চলমান আছে, প্রতিনিয়ত আবেদন পড়ছে। আগেরগুলো শেষ হয়ে যাবে, এরমধ্যে নতুন আবেদন আসবে। বিষয়টা হচ্ছে, সিস্টেমটা ব্যবহার উপযোগী হবে কি না, আশা করছি সেটা ১০ মার্চের আগেই হয়ে যাবে। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, রমজানকে সামনে রেখে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে মার্চ ও এপ্রিলে দেড় লাখ টন করে মোট ৩ লাখ টন চাল দেয়া হবে। এ কর্মসূচির আওতায় ৩০ টাকা কেজি দরে ১৫ কেজি করে চাল পাবে ৫০ লাখ পরিবার।