ঢাকা শহরে যত্রতত্র সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, দখল ও দূষণে দিন দিন বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলছে। এরইমধ্যে ফের আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ড্যাপে শীথিলতা আনতে যাচ্ছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার ড্যাপ সংশোধনী নিয়ে সচিবালয়ে ঘণ্টাব্যাপী মিটিং হয়েছে।
নগরী বাসযোগ্য করতে ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ২০২২ সালের আগস্টে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ কার্যকর হয়, যা ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কবলে পড়ে ফের ড্যাপ সংশোধনীর তোরজোড় চলছে। আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় ড্যাপ সংশোধনী আত্মঘাতির শাসিল বলে মনে করছেন নগরপরিকল্পনাবিদরা।
জানা গেছে, ড্যাপ সংশোধন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা চূড়ান্ত করতে সরকারকে ১৫ দিন সময় বেঁধে দেয় আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব। এরই আলোকে গতকাল বুধবার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খানের নেতৃত্বে সচিবালয়ে মিটিং হয়েছে। ওই মিটিংয়ে মন্ত্রণালয়ের একজ্বন অতিরিক্ত সচিব, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার, রাজ্বধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজ্বউক) চেয়ারম্যান মেজ্বর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.) এবং রাজ্বউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলামসহ কয়েকজ্বন উপস্থিত ছিলেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ড্যাপ সংশোধনী নিয়ে আগামী ১০ মার্চ উপদেষ্টা পরিষদে মিটিং আছে। ড্যাপে কোন বিষয়গুলো সংশোধনী আনা হবে সেব্যাপারে আগেভাগে প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। আগের ড্যাপের বিষয়গুলোর কিছু খসড়ায় শীথিলতা আনা হয়েছে। রাজ্বউকের আওতাধীন এলাকায় ভবন নির্মাণ করতে হলে দুই ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। প্রথমত, ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র। দ্বিতীয়ত, নির্মাণের অনুমোদন। ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র দেয়া হয় ড্যাপ অনুসরণ করে। অন্যদিকে নির্মাণ অনুমোদন দেয়া হয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। নতুন ড্যাপে দুটোই পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হাউজিং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার্থে ড্যাপে সংশোধনী আনা হচ্ছে। নতুন ড্যাপে আবাসন চাহিদা পূরণে প্লটভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ এবং সুবিধা রাখা হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) পুনর্বিন্যাসে। রাস্তার প্রসস্থতা যত বেশি হবে ফারের মান তত বাড়তে থাকবে।
নগরপরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রিহ্যাব ও তাদের অনুসারীরা ঢাকা শহরের বাসযোগ্য ইস্যুর চিন্তা না করে হাউজিং ব্যবসা চালানোর স্বার্থে ড্যাপ সংশোধনী চায়। চাপের মধ্যে বিগত সরকার ড্যাপ সংশোধন করেছে, এখন অন্তর্বর্তী সরকার এসে আবার ড্যাপ সংশোধনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও রাজ্বউক চেয়ারম্যান রিহ্যাবের দাবি বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। তারা ক্ষমতা পেয়েই বললেন- রিহ্যাবের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ড্যাপ করতে হবে। অথচ পৃথিবীর কোনো দেশে হাউজিং ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করতে আইন প্রণয়ন হয়নি।
তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের স্বার্থ এবং মানুষের স্বার্থ বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের স্বার্থে জুলাই-আগস্টের সরকার কাজ্ব করছে। এখানে পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ আমলে না নিয়ে ড্যাপ সংশোধনের দিকে যাচ্ছে।
জানা গেছে, ড্যাপের মাধ্যমেই ২০৩৫ সাল পর্যন্ত ভূমি ব্যবহার, আবাসন, পরিবহন, পানিনিষ্কাশন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, সামাজিক ও নাগরিকসেবা নির্ধারিত করা হয়েছে। জ্বনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দিয়েছে ড্যাপ। বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে স্থপতি ও আবাসন ব্যবসায়ীরা এর তীব্র সমালোচনা করেন। পরে সেই ব্যবস্থা থেকে সরে ফ্লোর এরিয়া রেশিও বা এফএআর ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করে রাজ্বউক। এতে করে আবার ধানমন্ডি, গুলশানের মতো পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় অন্যান্য এলাকার ভবনের আয়তন কমে যায়। আবারও সমালোচনা হলে গত বছর কিছু সংশোধন করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করে রাজ্বউক। তারপরও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
ড্যাপ সংশোধনের দাবি করে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব নেতারা বলেছেন, ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জ্বন্য পৃথকভাবে ভবন নির্মাণের যে এফএআর নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বৈষম্যমূলক। নির্দিষ্ট কিছু সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় এমনটি করা হয়েছে। এ কারণে বেশিরভাগ এলাকায় আগে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, তার তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে জ্বমির মালিক, ফ্ল্যাটের ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই ক্ষতির মুখে পড়বেন। শুধু তাই নয়, আশপাশের খাল-বিল, জ্বলাশয় ও কৃষিজ্বমি দ্রুত হ্রাস পাবে।
অবশ্য স্থপতিদের কেউ কেউ বলছেন, যে এলাকার রাস্তা সংকীর্ণ, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো নয়, খেলার মাঠ বা উন্মুক্ত অঞ্চল নেই, কাছে স্কুল বা হাসপাতাল নেই, সেসব জায়গায় যদি সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়, তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আরও বেশি মানুষ সেখানে বসবাস করবে। বিদ্যমান যে অবকাঠামো, তার ওপর আরও বেশি চাপ পড়বে।