ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

এগোচ্ছে নারী, এগোচ্ছে বাংলাদেশ

এগোচ্ছে নারী, এগোচ্ছে বাংলাদেশ

দেশের ক্রীড়াঙ্গন থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসন, রাজনীতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সর্বত্রে এগিয়ে চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি সহায়তার সুবাদে নারীদের কর্মদক্ষতা বাড়াতে দেশি-বিদেশি এনজিও এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়মিত কাজ কর করছে। নারী-পুরুষ বৈষম্যদূরীকরণ এবং শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের মতোই অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশের নারীরা। এ অগ্রযাত্রার মধ্য দিয়ে আজ ৮ মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ স্লোগানটি সমাজে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারীদের প্রতি ন্যায় ও সমতার ভিত্তিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে প্রতিফলিত করে।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসটি উপলক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এ উপলক্ষ্যে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে বরাবরের মতো এবারো ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও পৃথক কর্মসূচি পালন করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেক বছরে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে উঠে আসে নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে কতোটা এগিয়ে যাচ্ছে। একসঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে রাজনৈতিকভাবে নানা আন্দোলন ও প্রতিবাদের আয়োজন করা হয় এ দিনটি ঘিরে। সেখানে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্য অন্যতম। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন সূচক যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস এবং প্রত্যাশিত গড় আয়ুতে বাংলাদেশ প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে। অর্থনীতি রূপান্তরের সঙ্গে বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক উন্নয়নের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন অন্যতম। বাংলাদেশ নারীর জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে তিনজন নারী প্রতিনিধি রয়েছেন। এরমধ্যে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও পরিবেশের ওপর গুরুত্বরোপ করেছেন। এছাড়াও মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন শারমীন এস মুরশিদ। তিনি দুই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ এবং দরিদ্র মানুষের সেবা প্রধান রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার দায়িত্বে আছেন ফরিদা আখতার।

প্রশাসন : প্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েই চলছে। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে চলছেন নারীরা। সহকারী কমিশনার ভূমি (এসি ল্যান্ড) থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নারী কর্মকর্তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারি হিসাবে দেশে ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবারের প্রধান হচ্ছেন নারী, যা ২০২১ সালে ছিল ১৬ শতাংশ।

পোশাক খাত : গত বছরের পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে- নারী ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশে সরকারি চাকরিতে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন নারী-পুরুষ কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে নারী ৪ লাখ ৯১ হাজার। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে বাংলাদেশে নারীদের অগ্রযাত্রায় লক্ষ কোটি মা ও বোন অদম্য গতিতে তাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি অধিকতর দৃশ্যমান করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বেঁচে আছে গার্মেন্ট-নারীদের শ্রমের ঘামে। কৃষি ক্ষেত্রেও এগিয়ে এসেছে নারী শ্রমিকরা। অপ্রাতিষ্ঠানিক সেক্টরেও নারীর বিপুল উপস্থিতি লক্ষণীয়। দোকানি নারী, জোগালি নারী, সবজি বিক্রেতা নারী। নারী উন্নয়নের অন্যতম সূচক হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানের ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলো তৈরি পোশাক খাত। এ খাতের মোট শ্রমিকের ৭০ শতাংশের বেশি নারী। আবার দেশের বৃহত্তম সেবা খাত হলো স্বাস্থ্যসেবা। এ খাতেও কর্মরতদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি নারী। বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের জিডিপি নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছে নারী। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছে।

নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন : নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে অনেক অর্জন রয়েছে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদে আসন সংরক্ষণের বিধান রাখা হয় এবং এক্ষেত্রে ৬৫(২) অনুচ্ছেদের প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত ৩০০ আসনে নারীর অংশগ্রহণেও কোনো বাধা রাখা হয়নি। এছাড়া সংবিধানের ১৯ (৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগ সমতা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো তো বটেই, উন্নত অনেক দেশ থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

ক্রীড়াঙ্গন : খেলাধুলায় বাংলাদেশের মেয়েদের সাফল্য রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ফুটবল, ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলায় তারা ভালো করছে। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতির ক্ষেত্রে যত অর্জন তার একটি অংশ দেশের খেলাধুলার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের অর্জনও অনেক। ২০২২ সালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবার নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ২০২৪ সালেও প্রতিপক্ষ সেই নেপালকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার বিজয়ী হয়েছিলেন বাংলাদেশের মেয়েরা। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার রানির মুকুট শোভা পায় বাংলাদেশের মেয়েদের মাথাতেই।

বিভিন্ন সেক্টরে নারী : নারীরা বিদেশে গিয়ে প্রবাসী আয় দেশে পাঠাচ্ছেন, কৃষিকাজ, উদ্যোক্তা ও কুটির শিল্পসহ দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন জায়গায় সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। কর্পোরেট সেক্টরেও এখন নারীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। দেশের ওষুধ শিল্পে পুরুষের পাশাপাশি নারীও দুর্বারগতিতে এগিয়ে চলছে। এছাড়া শিক্ষাক্ষেত্র, ওষুধ শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, চা শিল্প, প্রশাসন খাত, সামরিক ও বেসামরিক খাত, স্বাস্থ্য খাত, প্রযুক্তিগত খাত, ব্যাংক ও এনজিওতে নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রয়েছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও নারীরা সমানতালে ভূমিকা রেখে চলছেন। নারীর ক্ষমতায়নে শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক। নারীর ক্ষমতায়নের মাপকাঠি সবার জন্য এক রকম হতে পারে না, কারণ নারীদের অবস্থান, পরিবেশ ও প্রেক্ষাপট ভিন্ন। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে এবং সমাজের সবস্তরে নারীদের সমানভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, নারীকে তার নিজস্ব পরিচয় এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে সহায়তা করাই হবে নারীর ক্ষমতায়নের মূলমন্ত্র। জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক বৈষম্য ও অর্থনৈতিক প্রান্তিকতা নারীদের আরও অধঃস্তলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য নীতিগত, মানসিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন জরুরি। গ্রিন বাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন সভাপতি সুলতানা বেগম বলেন, পোশাক খাতের উৎপাদনে নারী শ্রমিকরা মুখ্য ভূমিকা রাখলেও তারা মজুরির ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। একই কাজের জন্য পুরুষের তুলনায় নারীদের কম মজুরি দেয়া হয়। সরকারি চাকরিতে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি দেয়া হলেও পোশাকশিল্পে এই ছুটি মাত্র চার মাস। এই বৈষম্যদূর করা খুবই জরুরি; কারণ, এটি নারীর পেশাগত অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক নারী দিবস ১৯০৮ সালে শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরুটা হয়। নিউ ইয়র্কের রাস্তায় প্রায় ১৫ হাজার নারী নেমে কর্মঘণ্টা কমানো, বেতন বৃদ্ধি ও ভোটের অধিকারের দাবি তোলেন। এর এক বছর পর সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ আমেরিকা প্রথম জাতীয় নারী দিবসের ঘোষণা দেয়। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে নারী শ্রমিকদের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনে ঘোষণা দেন নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবী ও সমাজতান্ত্রিক কর্মী ক্লারা জেটকিনের। সেখানে ১৭টি দেশের ১০০ জন নারী উপস্থিত ছিলেন এবং তারা সর্বসম্মতিক্রমে তার এই প্রস্তাব মেনে নেন। তবে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি এবং সুইটজারল্যান্ডে। আর এই দিবসের শতবর্ষ উদযাপিত হয় ২০১১ সালে। ১৯১৭ সালের আগ পর্যন্ত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তারিখটিও নির্দিষ্ট ছিল না, সেবার যুদ্ধের সময় রাশিয়ান নারীরা ‘রুটি ও শান্তি’র দাবিতে এক আন্দোলন শুরু করে, টানা চারদিন ধরে চলা সেই আন্দোলনে জার শাসনের অবসান ঘটে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নারীদের ভোটের অধিকার মেনে নেয়। যে দিন এই আন্দোলন শুরু হয় রাশিয়াতে সেদিন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী (কারণ তখন রাশিয়াতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মেনে চলা হত) ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি রোববার। আর এই দিনটা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ছিল ৮ মার্চ, তারপর থেকেই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি পায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত