আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি কোরআন নাজিল করেছি এবং আমি অবশ্যই তার হেফাজত করব।’ (সূরা আল হিজর, আয়াত-৯)। আল্লাহ পাক নিজে কোরআনের হেফাজত করেছেন তাই দেড় হাজার বছর পরও কোরআন মজীদে কোনোরূপ পরিবর্তন বা বিকৃতি আসেনি। কোরআনের কোনো বাক্য, শব্দ বা যতি চিহ্নেরও হেরফর হয়নি, প্রয়োজন পড়েনি। এ দিক থেকে ইতিহাসের এক মহাবিস্ময় এই কোরআন। তিন-চারশ’ বছর আগের বাংলা আজকে বুঝতে হলে ভাষাবিদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছাড়া উপায় নেই। ইংরেজির আদিরূপ ল্যাটিনেরও একই অবস্থা। অথচ সুদীর্ঘকাল পরও কোরআনের পাঠ, বুঝা ও লেখা সম্পূর্ণ নতুন। কোরআন পাঠকারী বা শ্রবণকারী কারো কাছেই পুরোনো দিনের কিতাব বলে মনে হয় না কোরআন মজিদ। পড়তে আরাম লাগে, বুঝতে কষ্ট হয় না। ভাষার ভাবের জটিলতা নেই। সত্যিই, মহানবী (সা.) কে আল্লাহতায়ালা মেরাজ ভ্রমণ, বক্ষ বিদারণ, চন্দ্র দ্বিখণ্ডকরণ প্রভৃতি যত অলৌকিক নিদর্শন দিয়েছেন তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হলো কোরআন।
চৌদ্দশ’ বছর আগে কোরআন নাজিলের সময় বিরুদ্ধবাদী কুরাইশরা কোরআন মুহাম্মদের (সা.)-এর প্রলাপ বা পৌরানিক গল্পকথা বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন- ‘তোমরা যদি আমার বান্দার ওপর যা নাজিল করেছি তার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ কর, তাহলে তার মতো গ্রন্থ তোমরা রচনা কর।’ প্রথমে কোরআনের দশটি সূরার মতো আরবি বাক্যাবলি রচনা করার চ্যালেঞ্জ দেয়া হয়। পরে চ্যালেঞ্জ এর কলেবর কমিয়ে দিয়ে বলা হয়, ‘তোমরা যদি তোমাদের দাবিতে সত্যবাদী হও, তাহলে কোরআনের একটি ছোট্ট সূরার মতো বাক্যসমষ্টি রচনা কর।’
এ কাজ একাই করতে হবে এমন শর্ত নেই। বরং ‘তোমাদের সঙ্গী সাথীদেরও আহ্বান কর, সবাই মিলে একটি সূরা রচনা কর।’ তখনকার দিনে আরবরা ছিল ভাষা ও সাহিত্যে বিশ্বসেরা, এখনও এই ময়দানে তারাই অনন্য, অতুলনীয়। কোরআনের এই চ্যালেঞ্জ সে যুগের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং কেয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত আছে। অথচ এই সুদীর্ঘকালেও পৃথিবীর কোনো পণ্ডিত এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার সাহস দেখায়নি।
কোরআন মজিদে উল্লেখ আছে, যবুর দাউদ (আ.) এর উপর, তাওরাত মূসা (আ.)-এর উপর, ইঞ্জিল ঈসা (আ.) এবং সহিফা ইব্রাহীম (আ.)-এর উপর নাজিল হয়েছে। কিন্তু এসব কিতাব এমনভাবে বিকৃত হয়েছে যে, কিতাবের নাম পর্যন্ত বদলে গেছে। এসব কিতাব এখন বাইবেলের ‘নতুন নিয়ম’ ও ‘পুরাতন নিয়ম’ নামে প্রচলিত। খ্রিষ্টানদের বাইবেল সম্পূূর্ণ জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে, তাতে কোনটি ইশ্বরের বাণী বা কোনটি ঈসার বাণী আলাদাভাবে বোঝার সুযোগ নেই। হিন্দুদের বেদ বেদান্ত তো ইশ্বরের বাণী বলে হিন্দুরাও দাবি করে না। বৌদ্ধদের ত্রিপিটক কোনো মতেই ইশ্বরের বাণী নয়; কারণ বৌদ্ধধর্মে ইশ্বরের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় না।
সেই তুলনায় মুসলমানরা বড় ভাগ্যবান যে, হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর উপর নাজিলকৃত কোরআন সম্পূর্ণ অবিকৃত ও অক্ষত অবস্থায় এখনো বিদ্যমান আছে। এর কারণ, আল্লাহ পাক নিজেই কোরআনের হেফাজত করেছেন। এ কাজ তিনি সরাসরি দুনিয়াতে এসে করেননি; বরং যুগে যুগে কোরআনের হাফেজদের মাধ্যমে এ কাজটি করেছেন। পৃথিবীর কোনো প্রতাপশালী জালেম শাসক যদি ছাপানো কোরআনের সকল কপি জ্বালিয়ে দেয় বা ধ্বংস করে, এরপরও কোরআনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে পারবে না, কারণ, কোরআন হাফেজদের অন্তরের সিন্ধুকে সুরক্ষিত।
যুগে যুগে কোরআনের হেফাজতের কাজ যেভাবে হাফেজদের মাধ্যমে হয়েছে সেভাবে হাফেজদের হেফাজত করেছে তারাবি নামাজ। প্রতি বছর রমজান মাসে তারাবি নামাজে হাফেজগণ আল্লাহ সামনে, উম্মতের আদালতে দাঁড়িয়ে কোরআন খতম করেন। সে চেতনায় সারাবছর বুকের মাঝে কোরআনের হেফাজত করেন। দেখা গেছে, যে হাফেজ একটানা দু’চার বছর তারাবিতে কোরআন খতম পড়ানোর সুযোগ পায় না, তিনি হেফজের অমূল্য সম্পদ হারিয়ে ফেলেন। তার মানে খতমে তারাবি অঘোষিতভাবে কোরআনের হেফাজত করে।
পৃথিবীতে মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের মাঝে ধর্মগ্রন্থ সম্পূর্ণ মুখস্ত করেছে বা এখনো কণ্ঠস্থ আছে এমন একজন লোকও নাই। এর কারণ, প্রথমত এসব গ্রন্থ মুখস্ত করা বা রাখার জন্য তারাবি নামাজের মতো কোনো প্রার্থনার ব্যবস্থা তাদের নেই। দ্বিতীয়ত এসব গ্রন্থের নির্ভেজাল একক কোনো সংস্করণ, সংকলন নেই। তৃতীয়ত তারা অকাট্যভাবে বিশ্বাস করে না যে, এটি আসমানী গ্রন্থ বা ইশ্বরের বাণী। পৃথিবীতে এমন উদাহরণ কী আছে, এক ব্যক্তি একটি ভাষা বুঝে না, অথচ তা মুখস্ত করে, করতে পারে আবার পরম যত্নে বুকের সিন্ধুকে সংরক্ষণ করে রাখে? অথচ মুসলমান ঘরের লক্ষ কোটি কচিকাচা ছেলেমেয়ে দেখুন, আরবি ভাষা বা কোরআনের অর্থ না বুঝেও তারা পরম যত্নে কোরআন মুখস্ত করে, বুকের গহিন কন্দরে সুরক্ষিত রাখে। কোরআন ও তারাবি নামাজের এই গুরুত্ব আমরা না বুঝলেও শত্রুরা ঠিকই বুঝে। এ জন্যে তাদের ইন্ধনে তারাবি নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক ছড়ানো হচ্ছে। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছি, তারাবি নামাজ ২০ রাকাত না হলে রমজানে পুরো কোরআন একবার খতম করা সম্ভব নয়। এই বিতর্কের ফল দাঁড়াবে, কোরআন হেফাজতের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া। এই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা উম্মতের সামনে সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি।