রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ রেখে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে সারা দেশে কর্মবিরতি পালন করেছেন চিকিৎসকরা। এতে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর সেবাদান বন্ধ রেখে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করা হয়। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন ইন্টার্ন ও সিনিয়র চিকিৎসকরা।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক), রংপুর মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করেন। এতে হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর বাড়তি চাপ সামাল দিতে হিমশিমে পড়েছেন কিছু সিনিয়র চিকিৎসকরা। হাসপাতালগুলোর ওয়ার্ডগুলোয় স্থায়ী চিকিৎসকদের সঙ্গে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এতদিন চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তারা কর্মবিরতি পালন করায় রোগীরা এখন ডাকাডাকি করেও সহজে চিকিৎসকের দেখা পাচ্ছে না। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, চিকিৎসক না থাকায় সেবা নিতে সমস্যা হচ্ছে। রোগীদের ভোগান্তিও পোহাতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা নানা কারণে ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির কারণে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে রোগীরা ফিরে যাচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা। কারণ অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে সিনিয়র চিকিৎসকরা চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে গেলেও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সিনিয়র চিকিৎসকরা।
চট্টগ্রামে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের বিক্ষোভে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল ডেন্টাল কলেজ, আইএএইচএস মেডিকেল কলেজ, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ, বিজিসি ট্রাস্ট মেডিকেল কলেজ এবং মেরিন সিটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। একই দাবিতে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক)সহ কুমিল্লার আরো ৩ মেডিকেল কলেজ, সিলেট মেডিকেল কলেজ ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা এ কর্মবিরতি পালন করেন। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক মোহাম্মদ সাবিক হোসেন বলেন, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দাবি বাস্তবায়নে বারবার বিক্ষোভ করার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্ণপাত করছে না। তবে দাবি আদায়ে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ। আমাদের দাবি মেনে চিকিৎসাসেবায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হোক। বিক্ষোভ ও মানববন্ধন পালন করেছেন। এছাড়া আমরা চট্টগ্রাম সির্ভিল সার্জনকে স্মারকলিপি দিয়েছি। আমাদের কর্মসূচি চলমান থাকবে।
চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ডা. মনোয়ার তারিক সাবু বলেন, পাঁচ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজশাহীর কোনো চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করবেন না বলে সম্মত হয়েছেন। এর আগে চিকিৎসকরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির পাশাপাশি বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেন। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের গেটের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা। এদিকে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে যোগ দিয়েছেন সিনিয়র চিকিৎসকরাও। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেন, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সব ইন্টার্ন চিকিৎসক কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেছে, দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
অন্যদিকে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমা (ডিএমএফ) চিকিৎসক ও ডিপ্লোমা মেডিকেল (ম্যাটস) শিক্ষার্থীদের আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য খাতকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা, আদালত অবমাননা, বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করার অপতৎপরতার প্রতিবাদ এবং ৪ দফা দাবি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে নেতারা বলেন, নামের আগে ‘ডাক্তার’ পদবি ব্যবহার সংক্রান্ত রিটের রায়কে কেন্দ্র করে নানা ধরনের কর্মসূচি ও শাটডাউনের মাধ্যমে দেশের আদালতের ওপর এমবিবিএস চিকিৎসকরা অন্যায়ভাবে চাপ প্রয়োগ করছেন। তাদের দাবি, আদালতকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে রায়কে নিজেদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমনটা করা হলে ডিএমএফ ও ম্যাটস শিক্ষার্থীদের নিয়ে কঠোর জবাব দেয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তারা। এমনকি পরবর্তীতে যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য সরকার দায়ী থাকবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। তাদের চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- অনতিবিলম্বে শূন্য পদে নিয়োগ এবং কমিউনিটি ক্লিনিকসহ সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নতুন পদ সৃজন করা, প্রতিষ্ঠান ও কোর্সের নাম পরিবর্তন করে অসংগতিপূর্ণ কোর্স কারিকুলাম সংশোধন করে ইন্টার্নশিপে লগবুক প্রণয়ন করতে হবে, বিএমডিএস স্বীকৃত ক্লিনিক্যাল বিষয়ে উচ্চশিক্ষার অধিকার প্রদান করতে হবে এবং প্রস্তাবিত অ্যালাইড হেলথ প্রফেশনাল বোর্ড খসড়া আইনের নাম পরিবর্তন করে ‘মেডিকেল এডুকেশন বোর্ড অব বাংলাদেশ’ নামকরণসহ প্রস্তাবিত ধারায় সংশোধনীসহ বাস্তবায়ন করতে হবে। বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ ডিপ্লোমা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বিডিএফের পক্ষ থেকে বিএমডিসি অ্যাক্ট-২০১০ এর বৈধতা নিয়ে ২০১৩ থেকেই হাইকোর্টে লড়ছে। আদালত এই মামলার রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেছেন। কোর্টের চলমান মামলার রায়কে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের কর্মবিরতি, কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ একদিকে দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতাবিরোধী এবং ফৌজদারি অবমাননার সমান। অন্যদিকে তাদের এসব কর্মসূচি দেশের সাধারণ মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিপ্লোমা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ ভূঁইয়া বলেন, আমরা চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স ও ছয় মাসের ইন্টার্নি করে চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত আছি। আমরা ছোট পর্যায়ের সার্জারিসহ প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছি। আমরা ১৯৮৭ সালের আইন অনুযায়ী বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু ২০১০ সালে বিএমডিসির দুইটি ধারার মাধ্যমে আমাদের অধিকার হনন করা হয়েছে। আমরা এর বিপক্ষে উচ্চ আদালতে রিট করেছি। রিটের রায় ১২ তারিখ দেবে। কিন্তু এমবিবিএস চিকিৎসকরা লকডাউন, শাটডাউনের ঘোষণা দিয়ে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।
আন্দোলনকারী ইন্টার্ন চিকিৎসকদের পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ১. ডাক্তার পদবি ব্যবহার সংক্রান্ত রিট প্রত্যাহার। মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টদের বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করা, যা ২০১০ সালে গত সরকার দিয়ে গেছে। ২. উন্নত বিশ্বের মান অনুযায়ী ওটিসি ড্রাগ আপডেট করা। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে ওষুধ ক্রয়-বিক্রয় আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে ঘোষণা। ৩. স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক সংকট নিরসনে দ্রুত শূন্য পদে ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ এবং আলাদা স্বাস্থ্য কমিশন গঠনপূর্বক ষষ্ঠ গ্রেডে চাকরি প্রবেশপথ তৈরি। প্রতিবছর চার থেকে পাঁচ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ করে চাহিদার ভারসাম্য বজায় রাখা। চিকিৎসকদের বিসিএসের বয়সসীমা ৩৪-এ উন্নীত করা। ৪. বেকার তৈরির কারখানা সব ম্যাটস প্রতিষ্ঠান এবং মানহীন মেডিকেল কলেজ বন্ধ ঘোষণা। তবে এরই মধ্যে শিক্ষাধীন ম্যাটস শিক্ষার্থী এবং ডিএমএফদের প্যারামেডিকস হিসেবে পদায়নের ব্যবস্থা করা এবং ৫. চিকিৎসকদের কর্মস্থলের নিরাপত্তায় চিকিৎসক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এ ক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য যে ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগে অতর্কিত সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে ডাক্তার সমাজের প্রতিবাদের মুখে সাতদিনের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, যা সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো আলোর মুখ দেখেনি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরা কর্মবিরতি দিয়ে মানববন্ধন করেছেন। মানববনন্ধনে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা জানান, সম্প্রতি ম্যাটস, ডিএমএফ ইস্যুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এবং ৫ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে টানা দ্বিতীয়বারের মতো ইন্টার্ন চিকিৎসকদের কর্মবিরতি এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন চলছে। এতদিন আন্দোলন চলমান থাকার পরও যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ-মিছিল করা হচ্ছে।