সরকারি চাকরিতে নিয়োগে বৈষম্যদূরীকরণে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে টানা আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীসহ চাকরিপ্রত্যার্শীরা। জুলাইয়ের এই দিনে (১২ জুলাই) ‘কোটা সংস্কার’ ইস্যুটি একদফা দাবিতে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। সংসদে আইন পাস করে স্থায়ী সমাধান ছাড়া রাজপথ ছাড়বেন না বলে হুঁশিয়ারি দেন। একই দিনে রাজধানীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল করেন। রাজশাহীতে রেলপথ অবরোধ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। প্রক্টরের অপসারণ এবং হামলাকারী পুলিশ সদস্যদের অব্যাহতি দিতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও বগুড়ায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন।
২০২৪ সালের ১২ জুলাই বিকেল ৪টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিল নিয়ে কলাভবন, ভিসি চত্বর, রাজু ভাস্কর্য হয়ে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তারা। এক ঘণ্টা অবস্থানের পর শনিবারের কর্মসূচি ঘোষণা করে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়। এ নিয়ে ১১ দিনের মতো শিক্ষার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করেন। আন্দোলন ঘিরে পুলিশ আগে থেকেই শাহবাগের মেট্রোরেল স্টেশনের কাছে ব্যারিকেট দেয়। এদিন আন্দোলনরতরা পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেননি। তবে আগের দিনের মতো পুলিশের সামনে গিয়ে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, বাধা যতই আসুক, সংসদে আইন পাস না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। আন্দোলনের সমন্বয়ক ও বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণ অঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের কতদিন রাস্তায় দেখতে চায়, কতদিন প্রহসনের সিদ্ধান্তের মধ্যে রাখবে, এটি সরকারই নির্ধারণ করুক। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দায় সরকারকে নিতে হবে।
গত বছরের ১২ জুলাই সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিকাল সাড়ে ৩টার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পরে সোয়া ৪টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ শুরু হয়। এসময় মধুর ক্যান্টিন ও আশপাশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে বিকাল সোয়া ৫টায় শাহবাগে যান। শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিলে পুলিশ চার পাশে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শাহবাগ হয়ে মোহাম্মদপুর ও ফার্মগেটগামী গণপরিবহণকে অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হয়েছে। তবে অ্যাম্বুলেন্সসহ অসুস্থদের বহনকারী যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করেছে। ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও শাহবাগে মিছিল ও সমাবেশ করেন।
শাহবাগে সমাবেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার সারা দেশে আমাদের আন্দোলন চলাকালে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলা হয়েছে। এর মাঝে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করেছে। এতে অনেকেই আহত হয়েছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা চাই এই কোটার একটি যৌক্তিক সমাধান হোক। শিক্ষার্থীরা এ সময় ‘কোটা না মেধা-মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম-সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘আঠারোর পরিপত্র-পুনর্বহাল করতে হবে’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক-মেধাবীরা মুক্তি পাক’, ‘সারা বাংলায় খবর দে-কোটাপ্রথার কবর দে’, ‘আমার সোনার বাংলায়-বৈষম্যের ঠাঁই নেই’, ‘জেগেছে রে জেগেছে-ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ইত্যাদি স্লোগান দেন।
জবিতে বিক্ষোভ মিছিল : বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীরা। বিকাল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। তারা ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্ক প্রদক্ষিণ করে ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে অবস্থান নেন। এতে সদরঘাট এলাকার আশপাশের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবি জুম্ম শিক্ষার্থীদের : সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সংখ্যালঘু জাতিসত্তাদের জন্য ৫ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন করেন জুম্ম শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার বিকাল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন করেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সংকট রয়েছে। দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তারা সমান সুযোগ-সুবিধা পান না। অনেক চড়াই উতরাই পার করে তাদের শিক্ষা অর্জন করতে হয়। তারা সমাজের অনগ্রসর। তাই সরকারি চাকরিতে তাদের ৫ শতাংশ কোটা বহাল রাখা যৌক্তিক।
আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে আন্দোলন দমাতে চায় সরকার-ইসলামী আন্দোলন : ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহবিষয়ক সম্পাদক মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম বলেছিলেন, সরকার ভারসাম্যহীন আচরণ করেছে। সরকার আদালতের কাঁধে বন্দুক রেখে কোটাবিরোধী আন্দোলন দমাতে চায়। শুক্রবার বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ইসলামী যুব আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : বিকাল ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের প্যারিস রোড হয়ে বিভিন্ন আবাসিক হল ঘুরে স্টেশন বাজার এলাকায় যাওয়ার পর শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করেন। এতে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার স্থানকে ‘ছাত্র আন্দোলন চত্বর’ নামে ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার প্রতিবাদ মিছিল থেকে চত্বরটির নামকরণ করা হয়। এ সময় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রক্টরের অপসারণ এবং হামলায় অংশ নেওয়া পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আলটিমেটাম দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহ : বিকাল ৫টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নগরীর গাঙ্গিনার পাড় মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। আনন্দমোহন সরকারি কলেজ, গভর্নমেন্ট কলেজ, নাসিরাবাদ কলেজ, ময়মনসিংহ মহাবিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজ শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নেন। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : শিক্ষার্থীরা বিকাল সাড়ে ৪টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। পরে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব’ ম্যুরালের পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
জাবি : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মশাল মিছিলটি শুরু করেন। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহিদ মিনারে এসে শেষ হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় : শুক্রবার জনসমুদ্রে রূপ নেয় চট্টগ্রামের কোটাবিরোধী আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরের কলেজগুলো থেকেও বিপুল শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। চবি শিক্ষার্থীরা ষোলশহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার লংমার্চ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন।