
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ডিসেম্বরের আগেই সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত তিন সংসদ নির্বাচনে যেসব কর্মকর্তা মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের এবার নির্বাচনি দায়িত্বে রাখছে না ইসি।
ইসির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিগত তিন নির্বাচনে যারা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন তাদের যথাসম্ভব বাদ দেওয়া, ইসির বিতর্কিত অফিসারদের ভোটের দায়িত্বে থেকে বিরত রাখা, সব ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন, পুলিশের শরীরে ক্যামেরা স্থাপন করা হতে পারে। এছাড়া নির্বাচনের আগে সব ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি বদল করা এবং নির্বাচনে লটারির মাধ্যমে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছে ইসি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনে এবার দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োজিত করার পাশাপাশি গত তিন নির্বাচনে সম্পৃক্ত ভোট কর্মকর্তাদের এবার নির্বাচনি দায়িত্বে রাখা হবে না। আমরা এটা সিরিয়াসলি দেখব। সিরিয়াসলি মানে অর্থাৎ ওদের রাখা হবে না এবং অতীতে যাদের মোটামুটি এরকম প্রমাণ পাওয়া যায়, সেটার বিষয়েও দেখব। ইসির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিগত তিন জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং অফিসার ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের বিস্তারিত তথ্য চেয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এছাড়া সরকারের আরও কিছু সংস্থা তথ্য চেয়েছে। এরই বিভিন্ন কর্মকর্তার তথ্য দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিগত তিন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নানা অভিযোগ ও বিতর্ক রয়েছে। বিরোধীদলের অংশগ্রহণ ছাড়াই একতরফা ও জালিয়াতির অভিযোগে এসব নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। নির্বাচন আয়োজন ও বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কর্মকর্তাদের ভোট থেকে বাদ দিয়ে এবার তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার গ্রেপ্তারের পর অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসিরা আতঙ্কে রয়েছেন। এ ছাড়া তিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ইসির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব, উপসচিব ও সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা; সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারাও আতঙ্কে রয়েছেন। এরইমধ্যে বিগত তিন নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে সরকার উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে। এমনকি এ আতঙ্ক পৌঁছে গেছে তৃণমূলের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা তথা প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার এবং পোলিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী স্কুল শিক্ষক পর্যন্ত। এ ছাড়া ভোট কেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা এসআই, এএসআই ও পুলিশ সদস্যরাও চিন্তায় রয়েছেন। এর মধ্যে অনেকে গ্রেপ্তার হতে পারেন।
গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের নজরদারিতে রেখেছেন। বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্বে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার বহু কর্মকর্তাকে পুরস্কার হিসেবে ভালো স্থানে পোস্টিং পেয়েছেন। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা। আর ভোট আয়োজনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাই হবে ইসির চ্যালেঞ্জ। নিজেদের নিরপেক্ষ ভূমিকার পাশাপাশি ভোটের দায়িত্বেও রাখতে হবে পক্ষপাতহীন কর্মকর্তাদের। জুলাই সনদের পাশাপাশি নির্বাচনের সব ধরনের আইনি সংস্কার শেষে দল ও অংশীজনের সংলাপ করে পুরোদমে দৃশ্যমান করতে হবে ভোটের কাজ। তাতে জনগণের মধ্যে নির্বিঘ্ন ভোটের পরিবেশ ও ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশাও প্রতিফলিত হবে।
ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবতি যাতে না ঘটে, সেজন্য বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দেন তিনি। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ ভোটের সুবিধার্থে করণীয় খতিয়ে দেখা, ভোটকেন্দ্র সিসিটিভির আওতায় আনা ও মনিটরিংয়ের বিষয়ে নির্দেশনা দেন গত ৯ জুলাই আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিমূলক কাজ এগিয়ে চলছে জানিয়ে গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা যে বিষয়টা এটা তো কনসার্ন মিনিস্ট্রি দেখবে। আমরা যতটুক বুঝতেছি তারা সিরিয়াস। ওরা মিটিং করছে পত্রপত্রিকা দেখছি। তাদের লাইনে কাজ আগাচ্ছে। যথাসময়ে নির্বাচনি পরিবেশ সন্তোষজন পযায়ে পৌঁছবে বলে আশা করেন তিনি। রুটিন কাজের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে সংলাপও হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদে অনেক কিছুরই সমাধান আসবে বলে মনে করেন এ নির্বাচন কমিশন।
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সরকারের জানিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আশা করি, সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যার ফলে নির্বাচনের জন্য একটা সমতল ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।ৃ নির্বাচনের এখনও দেরি রয়েছে। সময় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো, উৎকর্ষের।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীমের মতে, সামনে আইনশৃঙ্খলাটাই যেহেতু বড় চ্যালেঞ্জ, এজন্য সমন্বিত নির্বাচনি নিরাপত্তাব্যবস্থা সমন্বিত লাগবে। যার বড় অংশই হচ্ছে সিসিটিভি স্থাপন ও মনিটরিং। তিনি বলেন, এখন নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা দরকার। আমাদের সামনে কি কি রিস্ক আসতে পারে, কি কি চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, কি কি ঝুঁকি আসতে পারে- এই চ্যালেঞ্জগুলো আইডেন্টিফাই করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এখানে ইলেকশন কমিশন তো অবশ্যই লিডিং পজিশনে থাকবেন। সাথে অন্যান্য যে সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যত আছে সবাইকে এটার সঙ্গে ইনভলভ করে এসেসমেন্টটা করে তারপর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
অন্যদিকে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও শপথ ভঙ্গের কারণে বিগত তিন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের বিচারের আওতায় আনতে কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন’। একই সঙ্গে হত্যা, গুম ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িতরা যেন নির্বাচনে অংশ না নিতে পারে, সে বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গত ৩ নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, তারা শপথ ভঙ্গ করেছেন। তাদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে যারা খুন করেছে, মানুষদের গুম করেছে; তারা আবার রাষ্ট্র পরিচালনা করুক সেটা অধিকাংশ জনগণই চায় না। সেজন্য তাদের নির্বাচনের বাইরে রাখতে সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচনি অঙ্গনকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আতঙ্কে ‘রাতের ভোটের সহযোগী’ সাবেক ডিসিরা : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনগুলোতে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ৬৬ জন জেলা প্রশাসকের (ডিসি) মধ্যে ৪৫ জনকে সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) এবং ২১ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব কর্মকর্তা এখন চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ‘একতরফা’ ওই নির্বাচনে মোট ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়। বিএনপি ও এর নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করে। ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার শরিকরা। ওই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের (একাদশ জাতীয় সংসদ) মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জোটসঙ্গীরা ২৮৮টি আসনে জয় পায়। বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র সাতটি আসন। বাকি তিনটি আসন পায় বাকি দলগুলো। এ নির্বাচনেও ক্ষমতার অপব্যবহার, জালজালিয়াতি ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে ‘দিনের ভোট রাতে করার’ অভিযোগ আনা হয়।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের শুরুতে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ছয় মাসের মাথায় পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এসব নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয় ওএসডি ও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ৬৬ জন সাবেক রিটার্নিং অফিসারের (জেলা প্রশাসক) বিরুদ্ধে। সূত্র বলছে, নির্বাচনে অনিয়মের সহযোগিতা ছাড়াও তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে সাবেক এসব ডিসি বর্তমানে চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিয়ম করে কেউ অবসরে গেলেও শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন না। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে সেগুলো দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হবে। এ বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে কেউ কেউ গ্রেপ্তার হতে পারেন। এ কারণে তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।