ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৪ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শোক ও গৌরবের জুলাই

রণক্ষেত্র দেশ, ৩১ জনের মৃত্যু

উত্তাল চব্বিশের এই দিনে
রণক্ষেত্র দেশ, ৩১ জনের মৃত্যু

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল প্রায় অচল। এদিন জেলায় জেলায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ৩১ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২৪ জন, চট্টগ্রামে ও নরসিংদীতে দু’জন করে এবং রংপুর, সাভার ও মাদারীপুরে একজন করে নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ১১ জন শিক্ষার্থী ছিলেন। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে আহত হন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এর আগে ১৬ জুলাই আন্দোলনে সারাদেশে ছয়জন নিহত হন। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদের সংখ্যা ৩৭ জনে পৌঁছায়।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের দফায় দফায় ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। রাজধানীর উত্তরা, ধানমন্ডি-২৭, নীলক্ষেত, রামপুরা-মেরুল বাড্ডা, মিরপুর-১০, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া, মতিঝিলসহ আরও কয়েকটি পয়েন্ট রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাতে এক্সপ্রেসওয়েও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, নরসিংদী, মাদারীপুর, সিলেট, নাটোর, নেত্রকোনা, কক্সবাজার, জয়পুরহাটসহ জেলায় জেলায় প্রায় একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে মুহুর্মুহু টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ছোড়ে পুলিশ। এ সময় পুলিশের পাশাপাশি দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরাও। দিনভর সংঘর্ষে শুধু রাজধানীতেই মারা গেছেন ২৪ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ২ ও নরসিংদীতে ২ এবং ঢাকার সাভার, সিলেট ও মাদারীপুরে একজন করে মারা গেছেন। এদিন আহত হয়েছেন আরও সহস্রাধিক। তাদের মধ্যে কয়েকশ গুলিবিদ্ধ। আহত ও তাদের স্বজনদের আর্তচিৎকারে হাসপাতালগুলোর পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্তত ২২ সাংবাদিকও আহত হয়। মোবাইল ইন্টারনেটের গতি ফোর-জি থেকে নামিয়ে টু-জিতে নামিয়ে আনে বিটিআরসি। এ কারণে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢুকতে পারেননি ব্যবহারকারীরা। মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বিঘেœর কথা স্বীকার করেন তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

জানা যায়, সংঘর্ষে রাজধানীর উত্তরায় ১২ জন, ধানমন্ডিতে একজন, যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়ার তিনজন এবং আজিমপুরের দুজন মারা যায়। অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকা টাইমসের সিনিয়র রিপোর্টোর মেহেদী হাসান (৩৮) মারা যান। এদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১১ জনের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে ৮ জনকেই যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে আহত অবস্থায় আনা হয়েছিল। তারা হলেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ (২৫), ওয়াসিম (৪০), সাংবাদিক মেহেদি হাসান (৩২), ব্যবসায়ী নাজমুল (২৮), ব্যবসায়ী ইসমাইল (৩৬) এবং আনুমানিক ৩০ বছর বয়সি অজ্ঞাত ৩ জন। এছাড়া আজিমপুরের মোহাম্মদ (২২), রামপুরার অজ্ঞাত ১৮ বছরের যুবক মেডিকেলে মারা যান। এর বাইরে ইমরান হাসান (২২) নামে একজন আহত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। আইসিইউতে তার মৃত্যু হয়।

উত্তরায় দফায় দফায় সংঘর্ষে নিহত ১৩: সারাদিন পুলিশ-আন্দোলনকারী মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে বিমানবন্দর থেকে উত্তরা পর্যন্ত পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়। নিহতদের মধ্যে একজন চিকিৎসক (ডা. সজীব সরকার), তিনজন শিক্ষার্থী, একজন গাড়িচালক, আরেকজন মো. শাকিল হোসেন, তিনি একটি সংবাদমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হাউজবিল্ডিং থেকে রাজলক্ষ্মী মোড় পর্যন্ত সড়কে হাজারো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মাঠে নামেন। বেলা ১১টার দিকে স্থানীয় বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে জড়ো হন। পরে তারা মিছিল নিয়ে মূল সড়কে উঠতে চাইলে পুলিশ ও র‌্যাব তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। পরে সংঘর্ষ শুরু হয়। তাদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে করে পুলিশ ও র‌্যাব।

সরেজমিন উত্তর কুয়েত মৈত্রী, বাংলাদেশ মেডিকেল, উত্তরা ক্রিসেন্ট ও শিনশিন জাপানসহ একাধিক হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগের সামনে আহত কিছু শিক্ষার্থীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ জানান, রাজধানীর উত্তরায় পুলিশ ও র‌্যাবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে নিহত একজনকে হাসপাতালে আনা হয়। তাকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। এরপরও তার সঙ্গে থাকা শিক্ষার্থীরা তাকে ঢামেকে নিয়ে গেছেন। এছাড়া শতাধিক ছাত্র আহত অবস্থায় হাসপাতালে আসেন। তাদের অনেককেই চিকিৎসার পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এদিন সংঘর্ষে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। নিহত ওই শিক্ষার্থীর নাম মো. ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (ফারহান ফায়াজ)। তার বয়স ১৮ বছর। তিনি উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং ২০২৫ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। কলেজের এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সন্তানের মৃত্যুর খবর জানিয়ে ফেসবুকে এক পোস্টে ফায়াজের মা নাজিয়া খান জানিয়েছেন, ‘তারা আমার শিশুকে হত্যা করেছে। এমনকি তার বয়স ১৮ বছরও ছিল না। আমি ফারহান ফায়াজের হত্যার বিচার চাই।’

যাত্রাবাড়ী রণক্ষেত্র : যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় মুহুর্মুহু রাবার বুলেট, ছিটা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে পুলিশ। এতে চারজন পুলিশসহ ৪০ জন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং পথচারী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়।

নরসিংদী : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ভেলানগরে দুপুর সাড়ে ৩টার দিকে কোটা আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গেলে তাদের সঙ্গে ধাওয়া-পালটাধাওয়া শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে ২ জন নিহত ও অন্তত ১৫০ জন আহত হয়। নিহতরা হলেন-শিক্ষার্থী তাহমিদ তামিম ও ইমন মিয়া। তাহমিদ স্থানীয় এনকেএম স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। সে সদর উপজেলার চিনিশপুরে গ্রামের রফিক ইসলামের ছেলে। ইমন মিয়া পলাশ উপজেলার দড়িচর গ্রামের কাউয়ুম মিয়ার ছেলে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আন্দোলনকারীরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে উঠতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। এতে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, এসময় পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে মুহূর্তের মধ্যে জেলখানার মোড় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসময় পুলিশের গুলিতে স্কুলছাত্র তাহমিদ তামিম ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

টেকেরহাট (মাদারীপুর) : পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ ও ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। সংঘর্ষে পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। নতুন শহর, প্রধান সড়ক, সুমন হোটেল এলাকা, কলেজ রোড, পুরান বাজার, সিটি মার্কেট এলাকাসহ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে ৪ শিক্ষার্থী শকুনী লেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩ জন জীবিত উদ্ধার হলেও দীপ্ত দে (২২) নামে এক শিক্ষার্থী নিখোঁজ থাকে। পরে দুপুরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন শকুনী লেকের দক্ষিণ পাড় থেকে দীপ্ত দে’র লাশ উদ্ধার করে।

সিলেট : শহরের সুরমা আবাসিক এলাকার বিভিন্ন মেসে রাত ৮টার দিকে তল্লাশি শুরু করে ছাত্রলীগ। এ সময় পালাতে গিয়ে খাল পার হওয়ার সময় পানিতে পড়ে রুদ্র সেন (২২) নামে এক শিক্ষার্থী মারা গেছেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন।

হবিগঞ্জ : আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুপুর ১২টা থেকে থেমে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। বেলা ১টার দিকে শহরের বিভিন্ন স্থানে এ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কয়েকশ’ রাউন্ড রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হয়।

বগুড়া : আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়। বেলা সাড়ে ১০টার দিকে সরকারি আজিজুল হক কলেজে শুরু হওয়া সংঘর্ষ প্রথমে সাতমাথায় ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়লে পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। থেমে থেমে এ সংঘর্ষ চলে দিনভর। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও আর্মড পুলিশ শত শত রাউন্ড রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। শুধু দুটি সরকারি হাসপাতালে ৫৩ জনকে ভর্তি করা হয়। আহতদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ। বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ২৫ জন আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়।

এদিন যশোরের কেশবপুরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক, রাজবাড়ীতে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া ও রাজবাড়ী-ফরিদপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক, ঝালকাঠির রাজাপুরে খুলনা-বরিশাল মহাসড়ক, গাজীপুরের শ্রীপুরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, বরিশালে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়ক, পঞ্চগড় শহরে ঢাকা-পঞ্চগড় মহাসড়ক এবং কক্সবাজারে চট্টগ্রাম- কক্সবাজার ও কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক এবং রাঙামাটি ও লক্ষ্মীপুর শহরে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত