
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের তিন দিনের মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বাড়াতে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি নোট বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম কুয়ালালামপুরের পুত্রজায়ায় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এমওইউ ও নোট বিনিময় স্বাক্ষর অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন। প্রথম নোট বিনিময়টি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য স্বাক্ষরিত হয়। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো’ সেরি উতামা হাজি মোহাম্মদ বিন হাজি হাসান এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল নিজ নিজ দেশের পক্ষে নোট বিনিময়ে স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় নোট বিনিময়টি কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতার জন্য স্বাক্ষরিত হয়। এতে মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো’ সেরি উতামা হাজি মোহাম্মদ বিন হাজি হাসান এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে প্রথম এমওইউটি হয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে। মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাতো’ সেরি মোহাম্মদ খালিদ বিন নরদিন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এতে স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় এমওইউটি হলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ, এলএনজি অবকাঠামো, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিষয়ে। মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী দাতুক সেরি আমির হামজাহ বিন আজিজান এবং বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম ফওজুল কবীর খান এতে স্বাক্ষর করেন। তৃতীয় নোট বিনিময়টি হালাল ইকোসিস্টেমে সহযোগিতা বিষয়ে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের উপমন্ত্রী সিনেটর ড. জুলকিফলি বিন হাসান এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এতে স্বাক্ষর করেন।
তৃতীয় এমওইউটি মালয়েশিয়ার ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে। আইএসআইএস মালয়েশিয়ার চেয়ারম্যান দাতুক প্রফেসর ড. মোহদ ফয়জ আবদুল্লাহ এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শামীম আহসান এতে স্বাক্ষর করেন।
চতুর্থ এমওইউটি মালয়েশিয়ার মাইমস সার্ভিসেস এসডিএন. বিএইচডি. (এমএসএসবি) এবং বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই)-এর মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে।এমএসএসবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ ফওজি ইয়াহায়া এবং বিএমসিসিআইয়ের শাব্বির আহমেদ খান এতে স্বাক্ষর করেন। পঞ্চম এমওইউটি মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এনসিসিআইএম) এবং বাংলাদেশের এফবিসিসিআইয়ের মধ্যে স্বাক্ষর হয়। এনসিসিআইএমণ্ডএর সভাপতি দাতো’ সেরি এন. গোবালাকৃষ্ণান এবং এফবিসিসিআই-এর প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান এতে স্বাক্ষর করেন।
মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আরও অধিকসংখ্যক বাংলাদেশি কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে তিনি গতকাল মঙ্গলবার কুয়ালালামপুরে সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক এবং দুই দেশের মধ্যে ৫টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) এবং তিনটি সহযোগিতামূলক নোট বিনিময় স্বাক্ষরের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ আশা প্রকাশ করেন। কুয়ালালামপুরের পুত্রজায়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়ায় কাজ করছে। তারা উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠান, যা তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাপন, সন্তানের লেখাপড়া এবং ভালো শিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করছে। আমরা আশা করি বাংলাদেশের জন্য এই দরজা খোলা থাকবে এবং আমাদের দেশের আরও অধিকসংখ্যক তরুণ-তরুণী এখানে কাজ করার সুযোগ পাবেন।’
বাংলাদেশের কর্মীদের মালয়েশিয়ায় কাজ করার সুযোগ দেওয়ায় দেশটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘মালয়েশিয়ার জনগণ তাদের সঙ্গে পরিবারের একজন সদস্য এবং বন্ধুর মত আচরণ করে। এতে তারা খুব খুশি। তারা অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি এখান থেকে অনেক কিছু শেখে, যা দেশে ফিরে যাওয়ার পর নিজের ব্যবসা দাঁড় করাতে সহায়ক হয়।’
মালয়েশিয়ার ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে একটা উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আপনারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন এবং প্রযুক্তি নিয়ে আসুন। আমাদের মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে আপনারা পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারেন।’
একটা টেকসই অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে বিনিয়োগ ও ব্যবসার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গত বছর ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমেছিল। আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক বিদায় নিয়েছে। এরপর নতুন সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আমরা সহযোগিতা খুঁজছিলাম, আর তখন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বন্ধুর মত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি আমাদের শক্তি জুগিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে সঠিক পথ নিশ্চিত করতে দৃঢ় সংকল্পের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা দেশে শৃঙ্খলা ফেরাতে পেরেছি। অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করেছি। ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আবারও কার্যকর করা গেছে। যে কারণে এক বছরের মাথায় এসে আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারছি।’ আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও জানান তিনি। প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট নিরসন এবং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির জন্য মালয়েশিয়ার জোরালো সমর্থন চান।
সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম আশা প্রকাশ করে বলেন, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চমৎকার সম্পর্ক উভয় দেশের জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে সহায়ক হবে।
এদিকে, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে মালয়েশিয়া উদ্বিগ্ন। গতকাল বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পুত্রাজায়ায় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা অবশ্যই তাতে উদ্বিগ্ন।’
আনোয়ার ইব্রাহিম আরো বলেন, মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অবশ্যই একটা বড় বিষয়। একই সঙ্গে দুর্ভোগে থাকা শরণার্থী ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি মানবিক সহায়তাও প্রয়োজন। তিনি নিউইয়র্ক, কলকাতা ও মালয়েশিয়ায় বহুপাক্ষিক ফোরামে উদ্যোগ নেওয়ায় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের প্রশংসা করেন। তিনি জানান, মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে একটি দল গঠন করে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে মিয়ানমার সফর করবেন। এর উদ্দেশ্য হলো, সেখানে শান্তি নিশ্চিত করা এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর যে নৃশংসতা চলছে, তার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা।
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক নিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মালয়েশিয়া বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে। কারণ বাংলাদেশের কর্মীরা এখানে একসঙ্গে কাজ করে মালয়েশিয়ার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তিনি বলেন, এ কারণেই মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মানবসম্পদ মন্ত্রী বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা সুবিধা চালু করতে সম্মত হয়েছেন, যাতে বাংলাদেশের কর্মীরা তাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারে এবং কর্মস্থলে নিরাপদ বোধ করে।
তিনি বলেন, ‘আপনারা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে আটকা পড়া কর্মীদের সহায়তার জন্য।’
আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, ‘আমরা পেট্রোনাসের সঙ্গে জ্বালানি খাতে এবং আজিয়াটার সঙ্গে টেলিযোগাযোগ খাতে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছি। পাশাপাশি এখন আমরা এই সহযোগিতাকে হালাল, এসটিইএম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত), গবেষণা এবং সেমিকন্ডাক্টর খাতে জোরদার করতে চাই।’
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে মালয়েশিয়ার একজন মহান বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, বাংলাদেশের এই ক্রান্তিলগ্নে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অধ্যাপক ইউনূস অসাধারণ অগ্রগতি এনেছেন। এখন তিনি মালয়েশিয়ার সঙ্গে বিনিয়োগ, বাণিজ্য, সংস্কৃতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পর্ক আরো উন্নয়নে কাজ করছেন। তিনি আরও বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনুসকে এই দেশের মানুষ চিনে তার অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য। যা দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য সুযোগ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে মাইক্রোক্রেডিট এবং কেদাহর আলবুখারি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ব্যবস্থা সৃষ্টি করা। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা সম্ভবত প্রথম সরকারি প্রতিনিধি দল হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন বন্ধুত্বের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি দেখাতে। তারা চান, একটি বিশাল সম্ভাবনাময় ও মালয়েশিয়ার মহান বন্ধু দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার জনগণের জন্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করুক।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার অংশীদারিত্ব গভীর করার অঙ্গীকার দুই দেশের সরকারপ্রধানের : মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে পুত্রজায়ার পার্দানা পুত্রা ভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। এ সময় উভয়ে দুদেশের সম্পর্ককে আরও গভীর এবং কৌশলগত ভবিষ্যতমুখী অংশীদারিত্বে রূপান্তরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রথমে দুই নেতা একান্ত বৈঠক করেন। এরআগে সীমিত সংখ্যক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে তারা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জনশক্তি ও জ্বালানি সহযোগিতা, নীল অর্থনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিস্তৃত পরিসরের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করেন। প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের মধ্যে ইতিহাস, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সহানুভূতির ভিত্তিতে গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। মানবসম্পদ, বাণিজ্য ও জনগণের পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া বাংলাদেশের অনন্য অংশীদার।’
প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম অধ্যাপক ইউনূসকে ‘মালয়েশিয়ার বন্ধু’ হিসেবে বর্ণনা এবং গত এক বছরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণ, শিক্ষা এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। একান্ত বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস প্রটোকল জটিলতার আওতায় আটকে পড়া ৮ হাজার বাংলাদেশি শ্রমিককে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের সুযোগ প্রদান এবং মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা চালুর জন্য মালয়েশিয়াকে ধন্যবাদ জানান। এর ফলে শ্রমিকরা জরুরি প্রয়োজনে দেশে ফিরে গিয়েও চাকরি হারানোর ঝুঁকি এড়াতে পারবেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দুই পক্ষই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন, যাতে খরচ কমে এবং শ্রমিকদের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়।
প্রতিনিধি পর্যায়ের আলোচনায় আইন, বিচার ও প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মালয়েশিয়াকে সরকার-টু-সরকার কাঠামোর মাধ্যমে আরও বেশিসংখ্যক দক্ষ বাংলাদেশি পেশাজীবী, যেমন চিকিৎসক ও প্রকৌশলী নিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বোয়েসেল বর্তমানে মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলোর জন্য শ্রমিক নিয়োগ পরিচালনার সক্ষমতা অর্জন করেছে। এছাড়া তিনি বাংলাদেশি নিরাপত্তারক্ষী ও সেবাকর্মীদের জন্য সুযোগ দেওয়া এবং মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত বা অনিবন্ধিত বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়মিতকরণের পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। মালয়েশিয়ার কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা এখন মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের সমান সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা পাবেন এবং বাংলা ভাষায় অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন।
বাংলাদেশ হাজারো শিক্ষার্থীর জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট পাস’ ভিসা চালুর অনুরোধ জানায়, যারা বর্তমানে মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। বর্তমানে প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী মালয়েশিয়ায় অধ্যয়নরত।
উভয় নেতা বাংলাদেশকে আসিয়ানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা গভীর করার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন, যার মধ্যে রয়েছে সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার মর্যাদা পাওয়ার প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে ড. ইউনূস আসিয়ানের চেয়ার হিসেবে মালয়েশিয়ার সমর্থন কামনা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়াকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলনে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি মালয়েশিয়ার একের পর এক সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান।
অর্থনৈতিক বিষয়ে, দুই পক্ষ বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনাকে ত্বরান্বিত করা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের মাধ্যমে বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদার করা এবং মালয়েশিয়া বাংলাদেশ যৌথ ব্যবসা পরিষদ সক্রিয় করার বিষয়ে একমত হন।
দুই বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে ঢাকা বাংলাদেশের ওষুধ, ব্যাটারি, জুতা, সিরামিক ও পাটজাত পণ্যের জন্য মালয়েশিয়ার বাজারে আরও প্রবেশাধিকার চেয়েছে।
বাংলাদেশ নীল অর্থনীতি ও হালাল শিল্প উন্নয়নে মালয়েশিয়ার সহায়তা কামনা করে, যার মধ্যে ঢাকার বাইরে একটি হালাল অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া আঞ্চলিক বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বে (আরসিইপি) যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে।
দুই দেশই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ ও জ্বালানি সহযোগিতার নতুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরকে স্বাগত জানায় এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি অংশীদারিত্ব অন্বেষণে সম্মত হয়। তারা প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি ও পর্যটন ক্ষেত্রেও সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার প্রশংসা করেন এবং প্রখ্যাত এশীয় সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দেন।
এর আগে অধ্যাপক ইউনূস পুত্রজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছালে তাঁকে লাল গালিচা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
উভয় নেতা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, এলএনজি সরবরাহ ও জ্বালানি সহযোগিতা, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ও মালয়েশিয়ার ইন্সটিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (আইএসআইএস)-এর মধ্যে সহযোগিতা, বাংলাদে-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ও মালয়েশিয়ান ইন্সটিটিউট অব মাইক্রোইলেকট্রনিক সিস্টেমস (এমআইএমওএস)-এর মধ্যে সহযোগিতা এবং এফবিসিসিআই (এফবিসিসিআই) ও এনসিসিআইএম (এনসিসিআইএম)-এর মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্কিত একাধিক সমঝোতা স্মারক বিনিময় প্রত্যক্ষ করেন। তারা কূটনৈতিক প্রশিক্ষণ, হালাল শিল্পখাত এবং উচ্চশিক্ষা সহযোগিতা সম্পর্কিত নোটও বিনিময় করেন। বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধান উপদেষ্টার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন।