ঢাকা শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সিইসির সামনেই কিল-ঘুষি

সিইসির সামনেই কিল-ঘুষি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ওপর জমা হওয়া আবেদনের ওপর শুনানিকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সামনে ধাক্কাধাক্কি-হাতাহাতি-কিল-ঘুষির ঘটনা ঘটে। এ বিষয়টি নিয়ে দিনভর উত্তেজনা বিরাজ করে নির্বাচন কমিশনে।

গতকাল রোববার দুপুর ১২টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) এই শুনানি শুরু হয়। শুনানিকালে বেলা একটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্যসংগঠক মো. আতাউল্লাহর অভিযোগ, তিনিসহ তার দলের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে। হামলা চালিয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা ও তার সঙ্গে থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা।

রুমিন ফারহানার দাবি, আতাউল্লাহ পরিচিত মুখ নন। তিনি এনসিপি থেকে এসেছেন, না জামায়াত থেকে এসেছেন, তা তিনি জানেন না। প্রথমে তাকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। তারপর তো আর তার লোকজন বসে থাকবেন না। তার লোকজনও জবাব দিয়েছেন।

আতাউল্লাহর দেখানো একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রুমিন ফারহানা স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছন আতাউল্লাহ নিচে পড়ে আছেন। তাকে কয়েকজন লাথি-কিল-ঘুষি দিচ্ছেন।

আতাউল্লাহ বলেন, শুনানিতে রুমিন ফারহানা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। কিন্তু যখন আমি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে যাই, তখন রুমিন ফারহানা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে স্টেজ দখলে নেন। পরে তার নেতাকর্মীরা আমাকে ফুটবলের মতো লাথি দেওয়া শুরু করেন। যেভাবে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের ক্যাম্পাসে পিষত, সেভাবে সবার সামনে আমাকে নিচে ফেলে পিষছে। আমার পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলেছে। হাতে আঘাত করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশন তখন কী করেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে আতাউল্লাহ বলেন, নির্বাচন কমিশন তখন আর কাউকে কথা বলতে দেয়নি। বিএনপি ছাড়া শুনানিতে জামায়াতে ইসলামীকেও কথা বলতে দেওয়া হয়নি।

এনসিপির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার প্রধান সমন্বয়কারী আমিনুল হক চৌধুরী বলেন, আমাদের দাবি হলো বিজয়নগরকে একত্র রাখা। রুমিন ফারহানা তিনটি ইউনিয়নকে বাগিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। যখন আমরা শুনানি করতে যাই, তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনের সামনে রুমিন ফারহানা ও তার গুন্ডাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের ওপর হামলা করেন। সবার সামনে আমাদের নিচে ফেলে যেভাবে পিষেছে, তাতে বোঝায়, এ দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন কখনো হবে না। এনসিপির নেতাদের অভিযোগের বিষয়ে রুমিন ফারহানা বলেন, মুশকিলের বিষয় হচ্ছে তিনি (আতাউল্লাহ) পরিচিত মুখ নন। তিনি এনসিপি থেকে এসেছেন, না জামায়াত থেকে এসেছেন, আমি জানি না। তবে উনি (আতাউল্লাহ) প্রথম, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত একজন আমাকে ধাক্কা দিয়েছেন। তারপর আমার লোকজন তো বসে থাকবে না। আমি তো একজন মহিলা এবং পরে যখন আমার লোকজনকে মারধর করেছে, আমার লোকজনও জবাব দিয়েছে। এটা সিম্পল।

রুমিন ফারহানা বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী (জেলা বিএনপির সভাপতি খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল) গুন্ডাপান্ডা নিয়ে ইসি ভবনে প্রবেশ করেছেন। তিনি (রুমিন ফারহানা) যখন একটা কথা বলার জন্য দাঁড়িয়েছেন, তখন তার গায়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যে বিএনপির নেতাকর্মীদের জন্য তিনি ১৫ বছর লড়াই করেছেন, তারা তাকে এখন ধাক্কা দেন। ধাক্কার বদলে তো ধাক্কা আসবেই। সেটাই হয়েছে।

সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে রুমিন ফারহানা বলেন, খালেদা জিয়া সব সময় বলেছেন, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় বিএনপি নির্বাচন করতে চায়। বর্তমান সীমানা একটি ফ্যাসিস্ট সরকার নিজেদের স্বার্থে নির্ধারণ করেছে, যা তারা মানেন না। তাই তারা চান, ২০০৮ সালের আগের সীমানায় ফিরে যাওয়া হোক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসন থেকে কেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ)-এর সঙ্গে যুক্ত করার খসড়া করেছে ইসি। এই ইউনিয়নগুলো হলো বুধন্তী, চান্দুরা ও হরষপুর। এর পক্ষে রুমিন ফারহানা।

মারামারির বিষয়ে খালেদ হোসেন মাহবুব শ্যামল বলেন, এখানে আসলে এনসিপির সঙ্গে ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার একটা তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এটা আসলে দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত। এই লেভেলে এসে এই ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। কমিশন শুনানি নিয়েছে। কিছু হট্টগোল হয়েছে, যেখানে আমাদের প্রতিপক্ষ অনেক ভুল তথ্য উপস্থাপন করেছে, যেগুলো কোনো যৌক্তিক নয়। আমরা মনে করি, এই তিনটি ইউনিয়ন সদর বিজয়নগরের সঙ্গেই থাকা উচিত।

খালেদ হোসেন মাহবুব বলেন, বিজয়নগরের ১০টি ইউনিয়ন থেকে ৩টি ইউনিয়ন আশুগঞ্জ ও সরাইলের সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের খসড়া করা হয়েছে। কিন্তু বিজয়নগরের এই তিন এলাকার লোকজন সরাইল ও আশুগঞ্জের সঙ্গে যেতে চাচ্ছেন না। তারা এই তিনটি ইউনিয়নকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সঙ্গে রাখার আবেদন জানিয়েছেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, রুমিন ফারহানা হলেন বিএনপির আওয়ামী লীগ বিষয়ক সম্পাদক। তিনি আওয়ামী আমলে সব ধরনের সুবিধা নিয়েছেন।

গতকাল রোববার নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে এনসিপি নেতা আতাউল্লাহসহ নেতাকর্মীদের মারধরের প্রতিবাদে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন তিনি।

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আওয়ামী লীগ পণ্য যাদের মনে হয় তাদের মধ্যে রুমিন ফারহানা অন্যতম। উনি সবসময় বলে থাকেন, বিগত ১৫ বছর নাকি উনি অনেক ভালো ছিলেন। উনি অবশ্যই ভালো থাকবেন। কারণ উনি যত ধরনের আওয়ামী সুবিধা রয়েছে, সব ধরনের সুবিধা নিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজকে নির্বাচন কমিশন যে ভূমিকা রেখেছে আমরা সেই ভূমিকাকে সবসময় প্রশ্নবিদ্ধ করে এসেছি। আমরা পুলিশকে দেখেছি এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। আমরা দেখলাম পুলিশ আমাদের নেতাকর্মীদের কীভাবে কমিশনে ঢুকতে বাধা দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীদের কীভাবে ফ্রি এন্ট্রি দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশন কতিপয় পার্টির ‘পার্টি অফিস’ হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। রুমিন ফারহানা এখানে বলেছেন যে মূলত বিএনপির লোকজন এখানে গুন্ডাপান্ডা নিয়ে ঢুকেছে, তারা তাকে ধাক্কা দিয়েছেন। এমন অভিযোগ তিনি করেছেন, এনপিসির বিরুদ্ধে করেননি। সাংবাদিকদের এ কথার জবাবে এনসিপির মুখ্য সংগঠক বলেন, আমরা যদি রুমিন ফারহানার কথাই ধরে নিই, নিজ দলের মধ্যে এখন পর্যন্ত কমান্ড নিশ্চিত করা হয় না। মানে বিএনপি নেতাকর্মীরাই, উনার কথা মতে, উনাকে সেখানে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। আমরা বলব, বিএনপি এত বড় একটা সংগঠন, সেই সংগঠনে আমরা চাই সংগঠনের শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।

এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক আতাউল্লাহ বলেন, আজ আমি যখন শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য আসি আমাকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এখানে গুন্ডাপান্ডা দিয়ে এরকম এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আমাকে পেছন থেকে বারবার টেনে হিঁচড়ে গেট থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারপর একটা পর্যায়ে আমি গেটের ভেতরে প্রবেশ করি। ১২টার আগে আমি প্রবেশ করি। আমি দেখি এখানে রুমিন ফারহানার লোকজন। তারা শুনানিতে তাদের যুক্ত উপস্থাপন করেন। একটা পর্যায়ে যখন আমার সময় আসে, আমি শুনানিতে দাঁড়াই। দাঁড়ানোর পর রুমিন ফারহানা তেড়ে গিয়ে আমাকে প্রথমে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। আমাকে কথা বলতে দেননি এবং তার যে গুন্ডাপান্ডা ছিল তারা আমাকে পায়ের নিচে ফেলে নির্মমভাবে মারধর করে। তারা টার্গেট করে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এখানে মারধর করতে চেয়েছে। যাতে আমরা আমাদের যুক্তি উপস্থাপন না করি, আমরা যাতে কথা না বলি।

তিনি বলেন, আমি এ হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে বিচার চাই। যদি বিচার করতে ব্যর্থ হয় আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করছি।

এর আগে সংসদীয় এলাকার সীমানা নিয়ে দাবি-আপত্তির শুনানি রোববার শুরু করে নির্বাচন কমিশন। সীমানা পুনর্নির্ধারণে পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। শুনানির শুরুতে সিইসি বলেন, আমরা পেশাদারিত্বের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি। আইন অনুযায়ী খসড়া সীমানা নিয়ে দাবি-আপত্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আপনাদের আবেদনগুলো আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। এখন শুনানিতে যৌক্তিক বিষয়গুলো তুলে ধরবেন। এদিকে ঢাকা-১৯ আসন থেকে দুটি ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করার প্রতিবাদে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন স্থানীয়রা। এতে সড়কের ঢাকামুখী লেনে যানজট সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বলিয়ারপুর বাসস্ট্যান্ডে ঢাকামুখী লেন অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কয়েকজন জানান, ঢাকা-১৯ আসন ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। এখানকার ভোটার সংখ্যা ৭ লাখের বেশি। এই সংসদীয় আসনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কিন্তু এখন অপরিকল্পিতভাবে আসনটিকে বিন্যাস করা হয়েছে। যেখানে বিরুলিয়া ও বনগাঁও ইউনিয়নকে ঢাকা-২ আসনের (মূলত কেরাণীগঞ্জ) সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত এই দুই ইউনিয়নের বাসিন্দারা মানতে পারছেন না। তারা বিরুলিয়া ও বনগাঁও ইউনিয়নকে আগের মতো ঢাকা-১৯ আসনের সঙ্গে যুক্ত রাখার পক্ষে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত