ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

যৌথ সংবাদ সম্মেলন

সীমান্তে হত্যা নিয়ে বিএসএফের ব্যাখ্যায় দ্বিমত বিজিবির

* সীমান্তে হত্যা বন্ধে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে : বিজিবি মহাপরিচালক * নিয়ম মেনে ‘পুশ ইন’ করা হচ্ছে: বিএসএফ মহাপরিচালক
সীমান্তে হত্যা নিয়ে বিএসএফের ব্যাখ্যায় দ্বিমত বিজিবির

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা কোন পরিস্থিতিতে গুলি ছোড়ার পথ বেছে নিচ্ছে, তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের মহাপরিচালক দালজিৎ সিং চৌধুরী, যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। দালজিৎ সিং বলছেন, সীমান্তে বিএসএফ সদস্যরা ‘অনুপ্রবেশকারীদের ধারালো অস্ত্রের আক্রমণের’ শিকার হচ্ছেন। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ‘শেষ পদক্ষেপ’ হিসেবে গুলি ছোড়ার মত প্রক্রিয়াকে বেছে নিচ্ছেন তারা। কিন্তু সম্প্রতি অনেকটা প্রকাশ্য দিবালোকে সীমান্তে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ককে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলনের শেষ দিনে গতকাল বৃহস্পতিবার পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের আয়োজিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দুই মহাপরিচালক যার যার অবস্থান তুলে ধরেন। ২৫ অগাস্ট শুরু হওয়া চার দিনের এই সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধ, ভারত কর্তৃক পুশ-ইন, সীমান্তে মাদক-জালমুদ্রাসহ অন্যান্য চোরাচালান বন্ধ এবং দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়। শেষ মুহূর্তে আলোচনাটি ‘অনির্ধারিতভাবে অনেকখানি দীর্ঘ হয়’ জানিয়ে নির্ধারিত সময়ের প্রায় দুই ঘণ্টা পর সংবাদ সম্মেলন শুরুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন বিজিবি মহাপরিচালক।

বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ (ঠেলে পাঠানো) আইনের মধ্যে থেকে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে করানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) মহাপরিচালক (ডিজি) দালজিৎ সিং চৌধুরী। বিএসএফের ডিজি বলেন, যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, শুধু তাদের বিরুদ্ধেই নিয়ম মেনে ‘পুশ ইন’ করা হচ্ছে। ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলনের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বিএসএফের মহাপরিচালক দালজিৎ সিং বলেন, এখন পর্যন্ত ৫৫০ জনকে বিজিবির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত ২ হাজার ৪০০ মামলার যাচাই–প্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনও এই কাজে সহযোগিতা করছে।

ভারতীয় ও বাংলাদেশি নাগরিকের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ‘পুশ ইন’ করায় মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিএসএফের পরিচালক বলেন, আইনের মধ্যে থেকে যথাযথ চ্যানেলে পুশ ইন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। ভারতের একজন নাগরিকের মেয়েকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হয়েছেসাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে দালজিৎ সিং চৌধুরী বলেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় জানানো হলে ভারত বিষয়টি গ্রহণ (অ্যাকসেপ্ট) করবে।

সীমান্ত আইন লঙ্ঘনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে ডিপোর্টেশনের (প্রত্যাবর্তন) ওয়েল স্টাবলিস্ট (প্রতিষ্ঠিত) বৈধ চ্যানেল আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। যদি কেউ ভারতীয় নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে তাৎক্ষণিক গ্রহণ করা হবে। এবারের সম্মেলনে সীমান্ত হত্যা বন্ধে বিজিবি ও বিএসএফ কী ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, জানতে চাইলে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, এ বিষয়টি এবার সীমান্ত সম্মেলনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, যৌথভাবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা সম্পর্কে প্রেষণা প্রদান এবং অপরাধীদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম প্রতিরোধের মাধ্যমে এ ধরনের আক্রমণ, নির্যাতন ও হামলার ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। এক প্রশ্নের জবাবে বিএসএফের মহাপরিচালক বলেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অনুপ্রবেশকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ৩৫ জন বিএসএফ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন। সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ সদস্যরা প্রথমে সতর্ক করেন ও বাধা দেন। শেষ পদক্ষেপ হিসেবে গুলি করেন।

তবে বিএসএফের মহাপরিচালকের এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিজিবির মহাপরিচালক। তিনি বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন অল্প বয়সী নাগরিককে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ওই শিশু বর্ডার নিরাপত্তার জন্য কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ ছিল? তবে বিষয়টি নিয়ে আর কোনো কথা বলেননি বিএসএফের মহাপরিচালক। যৌথ আলোচনার দলিল স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের চার দিনব্যাপী ৫৬তম সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয় গতকাল। সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পর যৌথ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ভারতীয় প্রতিনিধিদল ভারতে প্রত্যাগমন করার কথা আছে। গত মঙ্গলবার সকালে পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরের সম্মেলনকক্ষে এই বৈঠক শুরু হয়।

সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ২১ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশগ্রহণ করে। এতে বিজিবির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সড়ক বিভাগ, ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, যৌথ নদী কমিশন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। অন্যদিকে বিএসএফ মহাপরিচালক দালজিৎ সিং চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশ নেয়। এ দলে বিএসএফের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ছাড়াও ভারতের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা ছিলেন।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এবারের সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিক কর্তৃক নিরীহ বাংলাদেশি নাগরিকদের গুলি করে হত্যা ও আহত করার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জবাবে বিএসএফের মহাপরিচালক সীমান্তে অতিরিক্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাতে টহল জোরদার করে সীমান্ত হত্যার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক বিএসএফ কর্তৃক অবৈধভাবে বিভিন্ন ব্যক্তি, ভারতীয় নাগরিক ও জোর করে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে ‘পুশ ইনের’ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানান তিনি। বিএসএফের মহাপরিচালক ভারতে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের পারস্পরিকভাবে সম্মত প্রক্রিয়া অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর আশ্বাস দেন।

সীমান্ত দিয়ে মাদকসহ চোরাচালান প্রতিরোধে ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা’র গুরুত্ব তুলে ধরে উভয় পক্ষ পাচার ও পাচারকারীদের রিয়েল টাইম তথ্য শেয়ার এবং অধিক সতর্কতার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সতর্ক ও দৃঢ় থাকার বিষয়ে একমত হয়।

উভয় পক্ষ সীমান্তবর্তী জনগণকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, মানব পাচার, সীমান্ত স্তম্ভ উপড়ে ফেলা ও অন্যান্য আন্তসীমান্ত অপরাধ থেকে বিরত রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে একমত হয়। সার্বিকভাবে উভয় পক্ষ সীমান্তের অলঙ্ঘনীয়তা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। উভয় পক্ষ সীমান্ত শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো উন্নয়নমূলক কাজ না করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান উন্নয়নমূলক কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে একমত হয়। এ ছাড়া যৌথ নদী কমিশন অনুমোদিত নদীর তীর সংরক্ষণকাজ সহজ করা এবং সীমান্তবর্তী অভিন্ন নদীগুলোয় অননুমোদিত কাজ বন্ধ রাখার ব্যাপারে একমত হয়।

‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় তিনবিঘা করিডরের মাধ্যমে দহগ্রামকে যুক্ত করার জন্য অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়ে বিএসএফের মহাপরিচালক ভারতের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার কাছে উপস্থাপন করে তা সমাধানের আশ্বাস দেন। উভয় প্রতিনিধিদল আন্তসীমান্তে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী অবস্থান করলে সে ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, বিজিবির মহাপরিচালক ফেনীর মুহুরীর চর এলাকায় স্থায়ী সীমান্ত পিলার নির্মাণ এবং ইছামতী, কালিন্দী, রায়মঙ্গল ও হাঁড়িভাঙা নদী এলাকায় সীমান্ত রেখা নির্ধারণের কাজ সম্পন্নের ব্যাপারে জোর তাগিদ দেন। বিএসএফের মহাপরিচালক এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার কাছে উপস্থাপন করে তা সমাধানের আশ্বাস দেন। উভয় পক্ষ কোনো ধরনের আকাশসীমা লঙ্ঘন না করার বিষয়ে একমত হয়। ভবিষ্যতে যেন কোনো ভুল–বোঝাবুঝি না ঘটে, সে জন্য পূর্বনির্ধারিত ফ্লাইট সম্পর্কে রিয়েল টাইম তথ্য শেয়ারের মাধ্যমে পরস্পরকে অবহিত করার বিষয়ে সম্মতি জানায়।

উভয় পক্ষ নিজ নিজ দেশের গণমাধ্যমে পরস্পরবিরোধী বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার বা গুজব ছড়িয়ে সীমান্তে যেন কোনো উত্তেজনা সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে উভয় দেশের গণমাধ্যমকে পরামর্শ দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়। উভয় মহাপরিচালক সীমান্তে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে যৌথভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

সীমান্তে হত্যা বন্ধের বিষয়ে বৈঠকে বিজিবি ও বিএসএফ কী ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হল জানতে চাইলে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, এ বিষয়ে এবারের সীমান্ত সম্মেলনে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে’ আলোচনা হয়েছে। সীমান্তে প্রাণঘাতি অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় রাতের বেলা টহল জোরদার করে সীমান্ত হত্যার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে বৈঠকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত