ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

‘ভারত আমাদের হাত বেঁধে মুখ ঢেকে সমুদ্রে ফেলে দেয়’

‘ভারত আমাদের হাত বেঁধে মুখ ঢেকে সমুদ্রে ফেলে দেয়’

নুরুল আমিন তার ভাইয়ের সঙ্গে শেষবার গত ৯ মে কথা বলেছেন। ফোনকল খুব সংক্ষিপ্ত ছিল, কিন্তু খবরটি ছিল ভয়াবহ।

নুরুল জানতে পেরেছেন, তার ভাই কায়রুল ও আরও চার স্বজনসহ ৪০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মিয়ানমারে বিতাড়িত করেছে ভারত সরকার। প্রাণ বাঁচাতে কয়েক বছর আগে এই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে ভারতে পালিয়েছিলেন শরণার্থী হয়ে।

মিয়ানমারে এখন একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করা জান্তার অনুগত বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষুদ্র-জাতিগোষ্ঠীর মিলিশিয়া ও সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। এ পরিস্থিতিতে নুরুলের আবার তার পরিবারকে দেখার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কোটায়। ‘আমি মানতেই পারি না যে, আমার মা-বাবা ও যাদের বিতাড়ন করা হয়েছে, তারা কী কষ্টে আছেন’, দিল্লিতে বিবিসিকে বলছিলেন ২৪ বছর বয়সি নুরুল।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে বিতাড়নের তিন মাস পর, বিবিসি মিয়ানমারে থাকা ওই শরণার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে লড়াইরত ‘বা হ্তু আর্মি (বিএইচএ)’ প্রতিরোধ দলের সঙ্গে থাকছেন। ‘আমরা মিয়ানমারে নিরাপদ বোধ করি না। এখানে পুরো এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রের মতো’, ভিডিও কলের মাধ্যমে বলেছেন সৈয়দ নুর। একটি বিএইচএ সদস্যের ফোন থেকে কল করেছেন তিনি। নুর একটি কাঠের তৈরি আশ্রয়শিবিরে ছিলেন। তার চারপাশে ছিলেন আরও ছয়জন শরণার্থী। বিবিসি এসব শরণার্থীর সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে, দিল্লিতে থাকা তাদের আত্মীয়দের কথা শুনেছে এবং তাদের অভিযোগ তদন্ত করা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদন সাজিয়েছে। জানা গেছে, এই ব্যক্তিদের দিল্লি থেকে বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে উড়োজাহাজে করে নেওয়া হয়, পরে নৌযানে রাখা হয়। এরপর জীবনরক্ষাকারী জ্যাকেট পরিয়ে আন্দামান সাগরে ফেলা হয়। তীরে পৌঁছে এখন মিয়ানমারে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি তারা। নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বহু রোহিঙ্গা মুসলিম দেশটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

‘মানুষকে কীভাবে শুধু সমুদ্রে ফেলা যায়?’, প্রশ্ন করেছেন নুরুল আমিন। ‘বিশ্বে মানবিকতা বেঁচে আছে, কিন্তু আমি ভারত সরকারের মধ্যে কোনো মানবিকতা দেখিনি।’ মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ার থমাস অ্যান্ড্রু বলেছেন, (ভারতের বিরুদ্ধে) এ অভিযোগের সপক্ষে ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ’ রয়েছে। তিনি এ তথ্য জেনেভায় ভারতের মিশনপ্রধানের কাছে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া পাননি।

বিবিসিও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। তবে এ প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অবস্থা ভারতে শঙ্কাজনক। ভারত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না; বরং ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’ অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য করে।

ভারতে রোহিঙ্গাদের একটি বড়সংখ্যক জনগোষ্ঠী রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রয়েছে বাংলাদেশে। সেখানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করেন। বেশিরভাগই ২০১৭ সালে মিয়ানমারে শুরু হওয়া নিষ্ঠুর সেনা অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছেন। মিয়ানমারে বহু প্রজন্ম ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই।

ভারতে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ২৩ হাজার ৮০০। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করছে, প্রকৃত সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি।

গত ৬ মে দিল্লির বিভিন্ন অংশে বসবাসকারী ও ইউএনএইচসিআরের শরণার্থী কার্ডধারী ৪০ জন রোহিঙ্গাকে স্থানীয় থানা থেকে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গাদের ছবি তোলা ও আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা পর একটি আটক শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। বিবিসিকে তারা এ তথ্য জানান।

নুরুল বলেন, তার ভাই তখন তাকে ফোন করে জানায়, তাকে মিয়ানমারে নেওয়া হচ্ছে এবং তাকে (নুরুল) আইনজীবী নিযুক্ত করতে ও ইউএনএইচসিআরকে জানাতে বলে।

৭ মে শরণার্থীদের দিল্লির পূর্বে হিন্দন বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখান থেকে তারা আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্য উড়োজাহাজে ওঠেন। ‘উড়োজাহাজ থেকে নামার পর আমরা দেখেছি, দুটি বাস আমাদের নেওয়ার জন্য এসেছে’, ভিডিও কলের মাধ্যমে বললেন সৈয়দ নুর।

তিনি আরও বলেন, বাসের পাশে লেখা ছিল ‘ভারতীয় নৌসেনা’। এটি ভারতীয় নৌবাহিনীকে বোঝায়। ‘যত দ্রুত সম্ভব আমরা বাসে উঠলাম, আমাদের হাত প্লাস্টিক দিয়ে বাঁধা হলো এবং মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হলো’, বলেন নুর। বাসে থাকা লোকজনের পরিচয় জানা যায়নি, তবে সামরিক পোশাক পরিহিত এই ব্যক্তিরা হিন্দি ভাষায় কথা বলছিলেন।

সংক্ষিপ্ত বাসভ্রমণের পর শরণার্থী দলকে বঙ্গোপসাগরে একটি নৌযানে ওঠানো হয়; সেখানে হাত খোলা ও মুখের কাপড় সরানোর পর বিষয়টি বুঝতে পারেন তারা। শরণার্থীরা নৌযানটিকে একটি বড় যুদ্ধজাহাজ হিসেবে বর্ণনা করেন- দুই তলা, দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০ মিটার (৪৯০ ফুট)।

‘অনেকেই টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও কালো সেনা বুট পরে ছিলেন’, ভিডিও কলে বলেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ। ‘সবাই একই রকম পোশাক পরেননি- কেউ কালো, কেউ বাদামি।’ সাজ্জাদ ভিডিও কলে নুরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সৈয়দ নুর বলেন, নৌকায় তারা ১৪ ঘণ্টা ছিলেন। খাবার দেওয়া হয়েছিল চাল, ডাল, পনির।

কিছু পুরুষ শরণার্থী জানিয়েছেন, নৌকায় তাদের ওপর নির্যাতন ও অপমান করা হয়েছে। ‘আমাদের সঙ্গে খুব খারাপভাবে আচরণ করা হয়েছিল’, বলেন নুর। ‘কিছু মানুষকে মারধর করা হয়েছে, একাধিকবার থাপ্পড় মেরেছে।’

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত