
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হিসাব-নিকাশ কষছে। সেই হিসাব-নিকাশে জামায়াতে ইসলাম জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে ১৮ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার নিয়োগে প্রশাসনের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেও যথাসম্ভব নিরপেক্ষ, সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। গতকাল মঙ্গলবার জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ১৮ দফা সুপারিশ পেশ করা হয়েছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে একথা বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবন সভা কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
জামায়াতের ১৮ দফা সুপারিশ : ১. জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানের লক্ষ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির পরই আগামী নভেম্বরে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। ২. উপদেষ্টা পরিষদে গৃহিত সর্বশেষ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ২০ নং অনুচ্ছেদের সর্বশেষ সংশোধনীর বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে তাদের নিজস্ব দলীয় প্রতীক ব্যবহার করতে হবে। অন্য কোনো দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না। এ বিধান বহাল রাখতে হবে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের জোটগতভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করার বিধান অন্তর্ভুক্তির জন্য নির্বাচনব্যবস্থা সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনই সুপারিশ করেছে। ফলে এ বিধান কোনোক্রমেই পরিবর্তন করা যাবে না। সংশোধিত বিধানই বহাল রাখতে হবে। ৩. নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের প্রত্যেক স্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। ৪. নির্বাচনি কাজের জন্য নিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথা প্রিসাইডিং, পোলিং, আনসার, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত বাহিনীকে নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। ৫. সব ভোটকেন্দ্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করতে হবে। ৬. সব ভোটকেন্দ্রের নির্বাচনী বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। ৭. বিগত অবৈধ নির্বাচনগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল এমন সব প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আগামী নির্বাচনে নির্বাচনি দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। শতভাগ লটারির ভিত্তিতে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (ডিসি, এসপি, ইউএনও এবং ওসি) নিয়োগ দিতে হবে। ৮. রিটার্নিং অফিসার এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অফিসারদের সঙ্গে সঙ্গে সাধ্যমতো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে থেকেও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সৎ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. সব ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
১০. নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা প্রদান নিশ্চিত করে নির্বাচনি মাঠ সমতল করতে হবে।
১১. সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। এছাড়া বিগত ফ্যাসিবাদি সরকারের আমলে দলীয় লোকদের রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে তা সরকারের কাছে জমা দিতে হবে।
১২. নির্বাচনি এলাকাগুলোতে যারা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাস ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে হবে।
১৩. ভোটারদের নির্ভয়ে আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে ভোটকেন্দ্রের নির্ধারিত এলাকার মধ্যেই শুধু নয় বরং এর বাইরেও নির্বাচনি এলাকার যে কোনো স্থানে সন্ত্রাসী তৎপরতার খবর পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক তা দমন করতে হবে।
১৪. ছবিসহ ভোটার তালিকায় ভোটারদের ছবি পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাই স্পষ্ট ছবিসহ ভোটার তালিকা পোলিং এজেন্টদের যথাসময়ে সরবরাহ করতে হবে।
১৫. নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত পোলিং, প্রিসাইডিং অফিসার, আনসার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাইকে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে তাদের ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে হবে।
১৬. প্রবাসী ভোটারদের ভোট প্রদানের পদ্ধতি সহজ করার জন্য ভোটার আইডি কার্ড বা পাসপোর্ট যে কোনো একটির মাধ্যমে ভোট প্রদানের সুযোগ দিতে হবে। রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলগুলোকে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে হবে।
১৭. নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও নিরপেক্ষতা যাচাই করতে হবে।
১৮. ফ্যাসিস্ট আমলে নিজেদের সুবিধামতো ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন করা হয়েছে। তাই অভিযোগ বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র পরিবর্তন করতে হবে।
বিএনপির প্রস্তাবের কড়া সমালোচনা জামায়াতের : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ১৮ দফা দাবি পেশ করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। বিশেষ করে গণভোটের বিষয়ে কমিশনকে জানিয়েছে দলটি। গতকাল মঙ্গলবার আগারগাঁওয়ে বেলা ১২টা ১০ মিনিটে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে জামায়াতে ইসলামীর সাত সদস্যের প্রতিনিধি দল। এতে নেতৃত্ব দেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনাররাও এতে উপস্থিত ছিলেন। প্রায় দুই ঘণ্টার সভা শেষে দুপুর সোয়া ২টা নাগাদ মিয়া গোলাম পরওয়ার সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানান।
বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের চার মাস আগেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্টের প্রবণতা দেখা গেছে। আমরা নির্বাচন কমিশনকে বলেছি, যেই বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে সেখানে তারা যেন অটল থাকেন। সম্প্রতি একটি দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে এসে এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে আপত্তি জানানো এবং তা পরিবর্তনের দাবি তোলার বিষয়টিকে ‘খুবই দুর্ভাগ্যজনক’ মনে করে জামায়াত। দলটির অভিযোগ, জেন্টলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট-এর মাধ্যমে আরপিও সংশোধনীর পরিবর্তনের প্রচেষ্টা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড লঙ্ঘনের খারাপ উদাহরণ। জামায়াত এই আপত্তি দেওয়াকে অ্যালার্মিং এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছে। তারা এই সংশোধিত বিধান বহাল রাখার দাবি করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকসহ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তাদের নিয়োগ না দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি প্রসঙ্গে জামায়াত এটিকে দুঃখজনক এবং অরাজনৈতিক চিন্তা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। জামায়াত দাবি করেছে যে তারা যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলেছে তার কোনো একটার মালিকানার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা এটিকে ব্যাড ট্রেডিশন আখ্যা দিয়ে বলেছে, পাল্টা বিবৃতি বা তালিকা দেওয়া রাজনৈতিক শিষ্টাচার নয়।
এর আগে গত রোববার জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে দলগুলোর নিজস্ব প্রতীকে ভোট করার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)-এর সংশোধনীর সঙ্গে একমত নয় বলে জানায় বিএনপি। ইসির এমন সিদ্ধান্তে আগের বিধান বহাল করার দাবিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনকে চিঠি দেয় দলটি। এই সংশোধনী নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবনা ছিল না এবং এটি গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করেছে বলেও জানিয়েছিল বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা মো. ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, জোট করলেও ভোট করতে হবে নিজস্ব প্রতীকে-গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এই সংশোধনীর সঙ্গে বিএনপি একমত নয়। আগের অবস্থা বহাল করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সিইসিকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই সংশোধনের প্রস্তাব ছিলো না। বিএনপি এর সঙ্গে একমত পোষণ করে না, এটি গ্রহণযোগ্য নয়। আলোচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে বিএনপি মনে করে।