
সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক জুলাইযোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির শারীরিক অবস্থা এখনও সংকটজনক এবং আগের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে সর্বশেষ সিটিস্ক্যানের রিপোর্টে তার মস্তিষ্কে ইসকেমিক পরিবর্তন রয়ে গেছে এবং কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তাদের ভাষায়, আপাতত কোনো ক্লিনিক্যাল উন্নতির লক্ষণ নেই; তাই কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্টেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ওসমান হাদির স্বাস্থ্যের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জন এবং হাদির চিকিৎসায় সরাসরি যুক্ত চিকিৎসক ডা. আব্দুল আহাদ এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরে নেওয়ার পর শরিফ ওসমান হাদির নতুন করে সিটিস্ক্যান করা হয়। সেই স্ক্যানের ফলে দেখা গেছে, তার মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহের ঘাটতিজনিত ইসকেমিয়া এখনো বিদ্যমান এবং আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। একইসঙ্গে ব্রেনের নিউরোলজিক্যাল রিফ্লেক্সগুলোতেও উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি লক্ষ্য করা যায়নি। ডা. আব্দুল আহাদ বলেন, হাদির শারীরিক অবস্থা বর্তমানে ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্যাটিক— অর্থাৎ অবনতি হয়নি, আবার উন্নতিও হয়নি। তার হৃদযন্ত্র সাপোর্টের মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস ভেন্টিলেশন সাপোর্টে রয়েছে এবং কিডনির ইউরিন আউটপুটও চিকিৎসা সহায়তার মাধ্যমে বজায় রাখা হচ্ছে। এদিকে, হাদির মাথার ভেতরে রয়ে যাওয়া গুলির অংশটি অপসারণে নতুন করে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হবে কি না- এমন প্রশ্নও উঠেছে। এ প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলির অংশটি মস্তিষ্কের ডিপ সিলেট অঞ্চলে অবস্থান করছে। এই পর্যায়ে সেটি অপসারণ করলেও যে ব্রেন ফাংশনে দৃশ্যমান উন্নতি হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বরং অস্ত্রোপচার বা দীর্ঘ জার্নির ঝুঁকি বর্তমান শারীরিক অবস্থায় আরও জটিলতা তৈরি করতে পারে।
ডা. আহাদ বলেন, কিছু মহল থেকে তাকে সিঙ্গাপুরের বাইরে ইউকে বা যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়ার আলোচনা শোনা গেলেও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের মূল্যায়নে বিষয়টি এখনো বাস্তবসম্মত নয়। কারণ, দীর্ঘ ভ্রমণের ধকল সহ্য করার মতো শারীরিক সক্ষমতা তার আছে কি না—সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের মতামত ও সম্মতিও গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা। সিঙ্গাপুরেই আপাতত চিকিৎসা চলবে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, বর্তমানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, হাদির চিকিৎসা সিঙ্গাপুর জেনারেল হসপিটালেই চলবে এবং তা থাকবে কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্টের আওতায়। নিয়মিত ইনভেস্টিগেশন ও ক্লোজ মনিটরিং করা হচ্ছে। তবে প্রতিদিন আলাদা করে জানানোর মতো নতুন কোনো অগ্রগতি নেই বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ডা. আব্দুল আহাদ আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাদির অবস্থা নিয়ে যেসব উন্নতির দাবি করা হচ্ছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। তার শারীরিক অবস্থা আগের মতোই সংকটজনক ও স্থির রয়েছে। চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে দেশবাসীর প্রতি গুজবে কান না দিয়ে ধৈর্য ধরার এবং তাঁর সুস্থতার জন্য দোয়া করার আহ্বান জানানো হয়েছে। চিকিৎসকরা আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে যে চিকিৎসা প্রোটোকল অনুসরণ করা হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতায় সিঙ্গাপুরেও সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাই দেওয়া হচ্ছে এবং সেটিই অব্যাহত থাকবে।
এদিকে দুপুরে হাদির শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরে ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনটির ফেসবুক পেজের একটি পোস্টে বলা হয়েছে, ‘স্বাস্থ্য স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করতে হলে প্রথমে শরীরকে সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল করতে হবে। চিকিৎসা সিঙ্গাপুর অথবা ইংল্যান্ড যেকোনো জায়গায় হতে পারে। ব্রেন সক্রিয় করার জন্য অপারেশন প্রয়োজন। বর্তমানে মূল লক্ষ্য হলো শরীর আর ব্রেনের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করা। ব্রেন ছাড়া শরীরের অন্য সব অঙ্গ সক্রিয় রয়েছে।’
ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টার মূল আসামি ফয়সলের মা- বাবা গ্রেপ্তার- র্যাব : শরিফ ওসমান বিন হাদি হত্যাচেষ্টা মামলার মূল আসামি ফয়সল করিম মাসুদের মা- বাবাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে দেড়টার দিকে র্যাবের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে র্যাব-১০ ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার হাসনাবাদ হাউজিংয়ে বিশেষ অভিযান চালায়। অভিযানে ফয়সলের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগম (৬০) গ্রেপ্তার হন।
র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়, হুমায়ুন-হাসি দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে ফয়সল তৃতীয়। ফয়সল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তার বোন মোসা. জেসমিন আক্তারের বাসায় প্রায়ই যাতায়াত করতেন। ঘটনার দিন রাতে জেসমিনের বাসায় একটি ব্যাগ নিয়ে ওঠেন ফয়সল। পরে বাসার ফাঁকা জায়গা দিয়ে ব্যাগটি ফেলে দেন। আবার আসামি তার ভাগনে জামিলকে (১৮) দিয়ে ব্যাগটি নিয়ে আসেন। আসামি তার ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোনের একটি বাসার ছাদ থেকে ফেলে দেন। অন্যটি তার মাকে দেন। সেখানে তিনি তার মা- বাবার সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে অবস্থান নিরাপদ মনে না হওয়ায় আসামি ফয়সাল আগারগাঁও থেকে মিরপুর, পরে শাহজাদপুরে চাচাত ভাই আরিফের বাসায় যান। সঙ্গে তার মা- বাবাও ছিলেন।
ফয়সালকে পালাতে সাহায্যের অভিযোগে রিমান্ডে নুরুজ্জামান : ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা মামলায় নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বলের তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। প্রধান অভিযুক্ত ফয়সাল করিম মাসুদকে প্রাইভেটকারে পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার পরবর্তী রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এ আদেশ দেন। বুধবার তাকে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মতিঝিল থানার পুলিশ পরিদর্শক ফয়সাল আহমেদ পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালত এ আদেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষে পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী আদালতে তার রিমান্ড চেয়ে বলেন, ওসমান হাদিকে হত্যা চেষ্টা মামলায় ইতোমধ্যে ফয়সালের বাব-মাতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার সবাইকে জিজ্ঞেস করার পরে আজকের আসামিকেও ঘটনার মধ্যে পাওয়া গেছে। ওইদিন ফয়সাল তার বোনের বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় এ আসামি তাকে গাড়ি দিয়ে পালাতে সাহায্য করে। এ মামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। এছাড়া প্রধান আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। এমনকি তার অবস্থান ও নিশ্চিত না। এজন্য আসামিকে রিমান্ডে নিলে সব বের হবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শুনানিতে বলেন, আসামি নুরুজ্জামান নোমানী ওরফে উজ্জ্বল ফয়সালকে মাইক্রো বাসে পালানোর জন্য সুযোগ করে দেন। অস্ত্র কোথায় আছে এটা বের করার জন্য তার পাঁচ দিনের রিমান্ড চাচ্ছি।
মামলার আসামি নুরুজ্জামান নোমানী আদালতের অনুমতি নিয়ে বলেন, আমি গাড়ি ভাড়া দিয়ে বিপদে পরে গেছি। আমি হোয়াটসঅ্যাপে রেন্ট এ কারের ব্যবসা করি। এর জন্য ফয়সালের সঙ্গে নয় মাসের পরিচয়। তবে গত তিন মাস তার সাথে যোগাযোগ ছিল না। ওইদিন হটাৎ করে ফয়সাল আমাকে গাড়ি পাঠাতে বললে আমি পাঠাই। কারণ এটা আমার ব্যবসা। এখন সে গাড়ি নিয়ে কি করবে সেটা তো আমি জানিনা। পরে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক জশিতা ইসলাম এ আসামিকে বলেন রিমান্ড মানে শাস্তি না, আপনি তদন্ত কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করেন।
হামলায় ব্যবহৃত বাইক ৮ জনের হাতবদল, ভুয়া নম্বর প্লেট হেলমেট উদ্ধার : হাদিকে হত্যার উদ্দেশে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বর প্লেট পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। রাজধানীর বনলতা আবাসিক এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় মোটরসাইকেল, হেলমেট ও ভুয়া নম্বর প্লেটটি উদ্ধার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।
পুলিশ জানায়, আট ব্যক্তির হাতবদল হয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের সহযোগী মো. কবিরের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মাইনুদ্দিন ইসলামের নামে মোটরসাইকেলটি কেনা হয়। বুধবার ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হামলায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির নম্বর প্লেট পরিবর্তনের বিষয়টি উদঘাটন করা হয়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শেরেবাংলা নগর থানাধীন পশ্চিম আগারগাঁও বনলতা আবাসিক এলাকায় একটি বাড়ির নিচ তলার পার্কিং থেকে মোটরসাইকেল ও হেলমেটটি উদ্ধার করা হয়। পরে ভুয়া নম্বর প্লেট পরিত্যক্ত অবস্থায় ম্যানহোলের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়।
মোটরসাইকেলটির মালিকানা শনাক্তে নিবিড়ভাবে তদন্ত করা হয়। হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির প্রথম মালিক ছিলেন আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। পরে শহিদুল, রাসেল, মার্কেটপ্লেস, ওবায়দুল ইসলাম, আনারুল, আনারুল থেকে পুনরায় ওবায়দুল হয়ে শুভ নামে এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলটি কেনেন। ৮ ব্যক্তির হাতবদল হয়ে হামলার ঘটনায় জড়িত প্রধান সন্দেহভাজন ফয়সালের সহযোগী মো. কবিরের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মাইনুদ্দিন ইসলামের নামে মোটরসাইকেলটি কেনা হয়। উদ্ধার মোটরসাইকেল, হেলমেট এবং ভুয়া নম্বর প্লেটটি ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলেও জানান ডিসি তালেবুর রহমান।
ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় ম্যাগাজিন ও গুলি উদ্ধার : শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি ফয়সল করিম মাসুদের বোনের বাসার পাশ থেকে দুটি ম্যাগাজিন ও ১১টি গুলি উদ্ধার করেছে র্যাব। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে কর্নেল গলিতে অভিযান চালিয়ে এসব গুলি ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। মঙ্গলবার রাতে র্যাব-২ এর গণমাধ্যম শাখা থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
হাদির অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, চিকিৎসা সিঙ্গাপুর বা যুক্তরাজ্যে হতে পারে : হাদির শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল হওয়ার অপেক্ষায় আছেন চিকিৎসকেরা। এরপরই তার অস্ত্রোপচার করা হবে। ইনকিলাব মঞ্চ তাদের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে এমনটি জানায়। হাদি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অস্ত্রোপচারের জন্য হাদিকে প্রস্তুত করতে হলে প্রথমে শরীরকে সম্পূর্ণভাবে স্থিতিশীল করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, হাদির চিকিৎসা সিঙ্গাপুর অথবা ইংল্যান্ড- যেকোনো স্থানে হতে পারে। ব্রেন সক্রিয় করার জন্য অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। বর্তমানে মূল লক্ষ্য হলো শরীর ও ব্রেনের মধ্যে সংযোগ পুনঃস্থাপন করা। ব্রেন ছাড়া শরীরের অন্য সব অঙ্গ সক্রিয় রয়েছে। হাদির জন্য বিশেষ দোয়ার আহ্বান জানিয়েছে পরিবার।