
‘মেডিটেইশন’ বা ধ্যান শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে- কেউ একজন নীরব পরিবেশে চুপচাপ বসে আছে, চোখ বন্ধ করে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তবে অনেকেই আছেন যারা কিছুক্ষণ স্থির বসে থাকতে পারলেও, অল্প সময়ের মধ্যেই অস্থির বোধ করেন। মনে হয়- ধ্যান বোধ হয় আমার জন্য নয়। তবে এটি একটি ভুল ধারণা। ওয়েলঅ্যান্ডগুড ডটকম-এ প্রকাশির এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘লিন্ডেন মুভমেন্ট ল্যাব’-এর যোগ প্রশিক্ষক ক্লেয়ার বাউম এবং ‘ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি’-তে বিশেষজ্ঞ ও সৃজনশীল শিল্প থেরাপিস্ট নোইলানি রদ্রিগেজ বলছেন, ‘ধ্যান মানেই স্থির হয়ে বসে থাকা নয়। বরং দেহের চলন অনেক সময় মনে প্রশান্তি এনে দিতে পারে, যেটা চুপচাপ বসে থেকে অনেকের জন্য সম্ভব নয়।’
নোইলানি রদ্রিগেজ বলেন, ‘মুভমেন্ট মেডিটেইশন’ বা চলমান ধ্যান এমন একটি মুহূর্তে নিয়ে আসতে সাহায্য করে যেখানে মনোযোগ ছিন্ন হয় না বরং মনোভাবনার কোলাহল থেমে যায়।’ এই পদ্ধতি মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি রক্তচাপ কমায় এবং মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। তিনি আরও বলেন, ‘শরীর, নিঃশ্বাস এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হতে পারাটাই চলমান ধ্যানের মূল শক্তি। এতে এক ধরনের জীবন্ত অনুভূতি তৈরি হয়, যা মনকে প্রশান্ত করে।’
যারা একেবারেই নতুন, তাদের জন্য রদ্রিগেজ একটি সহজ ধাপ উল্লেখ করেছেন। দাঁড়িয়ে শুরু করতে পারেন, অথবা প্রয়োজনে বসে নিতে পারেন। পায়ের সংযোগ অনুভব করা। পা মাটির সঙ্গে সংযুক্ত, তা অনুভব করতে হবে। আঙুল নাড়ানো, মেঝের স্পর্শ কেমন লাগছে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মোজা পরেছেন, না খালি পায়ে আছেন? পায়ের নিচে কি কার্পেট, কাঠ বা ঘাস রয়েছে? বসে থাকলে, দেহ চেয়ারের সঙ্গে কেমনভাবে যুক্ত, তা লক্ষ করতে হবে। নিঃশ্বাসের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। শ্বাস নিতে নিতে দুই হাত পাশে তুলুন, এবং ছাড়তে ছাড়তে নিচে নামান। কোনো চিন্তা মাথায় এলে, সেটাতে নজর দিতে হবে এবং নিজেকে মাফ করে দিতে হবে। এই ধরনের ধ্যান ঘরেই করা যায়, অফিসের চাপ থেকে বিরতি নেওয়ার জন্যেও এটি উপযোগী। ক্লেয়ার বাউম বলেন, ‘আমি হাঁটার ধ্যান অনেক শেখাই। প্রতিবার যখন আমি আমার কুকুর নিয়ে হাঁটতে বের হই, তখন ফোনে ব্যস্ত থাকা বা প্রকৃতিকে দেখা, এই দুটোর মধ্যে একটি বেছে নিতে হয়। যখন আমি ফোন সরিয়ে রাখি, তখন পায়ের শব্দ, গাছের নড়াচড়া, চারপাশের রং সব কিছুই আলাদা করে অনুভব করতে পারি।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাঁটার সময় নিঃশ্বাসের সঙ্গে পায়ের চলনের সমন্বয় করলে তা হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসপ্রশ্বাসকে স্থির করে দেয়। যেমন- পাঁচবার পা ফেলার সময় শ্বাস নেওয়া এবং পরবর্তী পাঁচবারের সময় শ্বাস ছাড়ার অভ্যাস করতে পারেন। একসময় চেষ্টা করতে হবে, ১০ ধাপে শ্বাস গ্রহণ এবং ১০ ধাপে শ্বাস ত্যাগ করতে। ধ্যানমগ্ন থাকতে সাহায্য করতে বাউম একটি মজার কৌশলের কথাও বলেন যাকে বলে ‘স্টপলাইট গেইম’। এতে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে না। রাস্তায় হাঁটার সময় যে দিকের সংকেতে চলা দেখায়, সেই দিকেই হাঁটতে হবে। এতে ‘ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণে’ থাকেন না, বরং নিজেকে সময় ও স্থানে ছেড়ে দেন। এই হাঁটা নিজেকে সচেতন করে তোলে। কেমন অনুভব করছেন? দেহের প্রতিক্রিয়া কী? মনে কী ভাবনা আসছে? এইসব অনুভব করার সুযোগ তৈরি হয়।
রদ্রিগেজ বলেন, ‘প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি গ্রহণ করাও ধ্যানের অংশ হতে পারে। যদি সমুদ্রের ধারে থাকেন, তাহলে বালিতে হাঁটার অভিজ্ঞতা নিতে হবে। পায়ের নিচে বালুর টান এবং পানির ছোঁয়া এক ধরনের উপস্থিতির অনুভব তৈরি করে।’ প্রতিদিনের কাজ যেমন রান্না করা, বাসা গোছানো, ছবি আঁকা বা কোনো প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটানো এসব কিছুই হতে পারে ধ্যানের মাধ্যম, যদি তাতে মনোযোগ দিয়ে যুক্ত থাকেন। যদি এত কিছু করেও মনে হয়, ধ্যান আপনার জন্য নয়, তাহলে আরও একবার চিন্তা করে দেখা উচিত। ক্লেয়ার বাউম বলেন, ‘আমি একজন যোগ প্রশিক্ষক। তবে আমার ধ্যানমূলক অভ্যাস হল পাহাড়ে চড়াই-উতরাই করে ওঠা নামা করা (রক ক্লাইম্বিং)। এই কাজ করার সময় যদি সম্পূর্ণ সচেতন না থাকি, তাহলে পড়ে যেতে পারি। তাই এই কাজটা নিজেকে পুরোপুরি সচেতন থাকতে বাধ্য করে।’ তিনি মনে করেন, ‘যাদের বেশি উত্তেজনা ও শারীরিক চ্যালেঞ্জ পছন্দ, তাদের জন্য এই ধরনের ধ্যানই হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর।’