প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ আগস্ট, ২০২৫
মুফতি আশরাফুল হক; লেখক, সম্পাদক ও আন্দোলনকর্মী। শিক্ষকতা করেন ঢাকার মাহাদুশ শায়খ ফুআদ লিদ্দিরাসাতিল ইসলামিয়ায়। চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার মতো ফুঁসে ওঠেন স্বৈচারিতার বিরুদ্ধে। প্রতিবাদে নামেন রাজপথে। বন্ধুমহল ও আলেমদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সাধারণ আলেম সমাজ’ নামে আন্দোলনের মুক্ত প্লাটফর্ম। পর্যায়ক্রমে যাত্রাবাড়ীতে বিশাল গণআন্দোলনে সক্রিয় হন তারা। তাদের সেই আন্দোলনের সূত্রে ধরেই আজকের অন্তবর্তী সরকারের জন্ম। তারা আন্দোলনে কীভাবে সক্রিয় ছিলেন, হেফাজতের আন্দোলনকে কোনভাবে দেখেন, অন্তবর্তী সরকার কেমন দেখছেন ও দেশ গঠনে আশাবাদ কেমন? নানা প্রসঙ্গ উঠে এসেছে তার সরল আলাপে। ‘সাধারণ আলেম সমাজ’-এর এ যুগ্ম আহ্বায়কের সঙ্গে কথা বলেছেন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের সহ-সম্পাদক মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
আলোকিত বাংলাদেশ : আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেন কীভাবে? সাধারণ আলেম সমাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন কখন?
আশরাফুল হক : ২০২৪-এর ১৮ জুলাই আন্দোলনকারীরা প্রথমবারের মতো যাত্রাবাড়ির কাজলারপাড় দখলে নেয়। এর আগেই রাস্তায় নেমেছি, তবে নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন দেখেছি। কিন্তু ১৮ তারিখে আন্দোলনকারী হিসেবে মিছিলে যাই। প্রতিদিন জোহরের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত রাস্তায় থাকতাম। কোনো কোনো দিন কাজলারপাড়, কখনও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজলা অংশে টহল দিতাম। আন্দোলন যখন তেঁতে উঠেছে, তার আগ থেকেই আলেম সমাজের অংশগ্রহণ নিয়ে ভেতরে দহন ছিল। বিক্ষিপ্তভাবে অনেককে নামতে দেখতাম। আমিও একা একা নামতাম। আন্দোলন করছি, পাশে একজনও পরিচিত মানুষ নেই। একদিন দেখি, আমার একজন ছাত্র মাদ্রাসার সবাইকে ফাঁকি দিয়ে রাজপথে নেমে এসেছে। আমি তাকে ডেকে বিব্রত করতে চাইনি। বিক্ষিপ্তভাবে এভাবে আন্দোলনে নামার বিষয়টি আমার কাছে যৌক্তিক কারণেই খারাপ লাগছিল। প্রথমত আমার ভেতর একটি স্থির বিশ্বাস জন্মেছিল, এ আন্দোলন স্বৈরাচারী বিরোধীদের জন্য ‘ডু অর ডাই’। বিক্ষিপ্ত অংশগ্রহণের কারণে বিজয় অর্জন হলে আলেমরা অংশগ্রহণ করেও স্বীকৃতি পাবে না। আরও ১০ জন বিক্ষিপ্ত অংশগ্রহণকারীর মতোই হারিয়ে যাবে। আন্দোলন-ভূমিকায় স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দল বা প্লাটফর্মের প্রয়োজন হয়। নইলে নিজেই সিগনেচার হয়ে যেতে হয়। যেমন- আবু সাঈদ ও মুগ্ধ দলের হয়ে আন্দোলন না করেও নিজেরা সিগনেচার। কিন্তু এমন অজস্র শহিদ আছেন, তাদের নিয়ে রাষ্ট্র কতটুকু মাথা ঘামাচ্ছে! আমার সহপাঠী শহিদ শিহাব। তাকে কে কতটুকু চিনছে! কিন্তু রিয়া গোপকে সবাই চেনে। সেও একটি সিগনেচার। দেড় হাজার শহিদের মধ্যে সবাইকে আলাদা করে পরিচিত করাও মুশকিল।
এদিকে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর তো তখনও কোনো রাজনীতি ছিল না। ইসলামী আন্দোলন ছাড়া কারও রাজনৈতিক স্ট্যান্ড নেওয়ার গাটসই ছিল না। পতিত সরকার সবার মেরুদণ্ড চূর্ণবিচূর্ণ করে রেখেছিল। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা আমাদের বোর্ড থেকেও সত্যিকারের অপারগতার কারণেই স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আবু সাঈদের শাহাদতের পর আমি ১৬ তারিখেই ফেসবুকে পোস্ট করি- ‘বেফাক বা হাইয়ার প্যাডে একটি বিবৃতি এসেছে কী?’ কিন্তু আমার এ পোস্টে অনেকে বিরোধিতা করেন। ১৭ তারিখে ঢাবির বিভিন্ন হল ছাত্রলীগমুক্ত হতে থাকে। আমার তখন মনে হয়েছিল, কোন ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবে, তা চিনতে ভুল করলে নেতৃত্বের অযোগ্য হব। সেই ইতিহাসের ঘটমান সময়ে দর্শকের সারিতে নীরবে বসে থাকলে জাতীয় পরিচয় বহনেরও অযোগ্য হব। তখন ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট করি, মজলুমের পাশে দাঁড়ানো বা পক্ষে জোরালো কথা বলা উম্মাহ-দরদের অন্তর্ভুক্ত নয় কী? আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন সরকারের নজরদারি ও পদলেহী ছিল, তেমনই আন্দোলনের ব্যাপারে ইতিবাচক ব্যক্তিদের সামনে শাপলা ও মোদিবিরোধী আন্দোলনপরবর্তী নির্দয় বাস্তবতাও ভৌতিক স্বপ্নের মতো তাড়া করছিল।
দ্বিতীয়ত বিক্ষিপ্ত অংশগ্রহণের ফলে আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে বরাবরের মতো অন্যরা ফায়দা লুটবে, যদি সফলতা আসে। আর যদি সফলতা না আসে, তাহলে অংশগ্রহণকারীরা নিজের ঘরেই ফিরতে পারবে না। এরা ভীষণ বিপদে পড়বে। তৃতীয়ত স্বৈরাচারবিরোধী এ বৃহত্তর আন্দোলনে আলেমরা সম্মিলিতভাবে অংশ না নিলে ভবিষ্যতে এর দায় বয়ে বেড়াতে হবে। সফলতা অর্জন হলে আমাদের তেমন কিছু বলার থাকবে না। বরং একদিকে আমরা যেমন নিপীড়িত ছিলাম, অপরদিকে যে কোনো অপারগতা থেকেই হোক না কেন, বিগত সরকারের সঙ্গে আলেমদের একটি ভালো সম্পর্কও চিত্রায়িত ছিল। ফলে আন্দোলনে সফলতা আসুক বা না আসুক, আমরা তো স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকব। ইতিহাসের দায় বয়ে বেড়াব আরেকবার। ইতিহাস বলে, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে দেশের কোনো অভ্যুত্থানেই আলেম সমাজের অবদান স্বীকৃতি পায়নি (?), বরং ক্ষেত্রবিশেষ অপাঙক্তেয় বা বিরোধী হিসেবে চিত্রায়িত হয়ে এসেছে। সাংগঠনিক শক্তিহীনতাই তো এর মূল! সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, সফলতা আমাদের অর্জন হবে। কষ্ট হবে, লড়াই হবে।
১৮ জুলাই ফেসবুকে লিখলাম, আমার চোখ বলছে, এই আগুন নেভানো অত সহজ নয়। আন্দোলনের ব্যাপ্তি এবং ধরণও আমাদের চূড়ান্ত বার্তা দিচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে আমাদের সম্মিলিত কোনো প্লাটফর্ম বা স্ট্যান্ড নেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আমি বিভিন্নজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলি। কিন্তু একেকজনের কাছে একেক বাস্তবতা শুনে নিরাশ হই। এরই মধ্যে পহেলা আগস্ট বিকেলে তানজিল আমাকে নক দেন। আমাদের কিছু একটা করণীয় বিষয়ে আলোচনা করে একটি প্লাটফর্মের প্রস্তাব জানান। আমি আগপাছ না ভেবে একবাক্যে রাজি হয়ে যাই।
আলোকিত বাংলাদেশ : এরপর ‘সাধারণ আলেম সমাজ’-এর ব্যানারে কারা কখন যুক্ত হন?
আশরাফুল হক : পতিত সরকারের অরাজকতার প্রতিবাদে চব্বিশের ১৮ জুলাই তরুণ আলেমদের নিয়ে সংহতি সমাবেশ করে বিবৃতি দেওয়া হলো। তখন থেকেই মূলত ‘সাধারণ আলেম সমাজ’ তরুণ আলেমদের নিয়ে একটি শক্তি তৈরি করে। ইসলামি মূল্যবোধ ও ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘সাধারণ আলেম সমাজ’ ছিল এ আন্দোলনের অরাজনৈতিক শক্তি। সংগঠনটির কনভেনার মাওলানা রিদওয়ান হাসানের নেতৃত্বে আলেম, মাদ্রাসাশিক্ষার্থী এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগণ ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাবলিগি চেতনায় তাদের কর্মসূচি বা ধর্মীয় আবহে রাজপথ ধরে রাখার কৌশল ছিল অত্যন্ত কার্যকর। আলেম সমাজের এ উদ্যোগ একদিকে যেমন আন্দোলনের স্থায়িত্বকে নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে ইসলামি চেতনাকে রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছেন- যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা রিদওয়ান হাসান, নুরুল কোরআন একাডেমির পরিচালক মাওলানা আবদুল্লাহ মাসউদ, ইসলামি লেকচারার মাওলানা তানজিল আরেফীন আদনান এবং লেখক ও সাংবাদিক মাওলানা রকিব মুহাম্মদ। পারস্পরিক যোগাযোগের অংশ হিসেবে সূচনাতেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। আমরা প্রথম যখন সংহতি সমাবেশ করি, তখনও আমাদের সুবিন্যস্ত কমিটি ছিল না। পরবর্তীতে একটি কমিটি করি। এ কমিটিতে আহ্বায়ক হন মাওলানা রিদওয়ান হাসান, যুগ্ম আহ্বায়ক হন আবদুল্লাহ আল মাসউদ, তানজীল আরেফিন আদনান, মুহিম মাহফুজ, আশরাফ মাহদী, ফরিদাবাদ মাদ্রাসার বর্তমান মুঈনে মুহতামিম মানযুর হাসান যুবায়ের, জামিয়া মুহিউচ্ছুন্নাহর পরিচালক মাছুম বিল্লাহ মাহমুদী, আতিকুর রহমান, যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার শিক্ষক হারুনুর রশিদ নোমানি এবং আমি। সদস্য সচিব হন রকিব মুহাম্মদ।
আলোকিত বাংলাদেশ : চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে ‘সাধারণ আলেম সমাজ’ কী কী অবদান রেখেছে?
আশরাফুল হক : সাধারণ আলেম সমাজের অবদান বহুমুখী। প্রথমত সেই উত্তপ্ত সময়ে সাধারণ আলেম সমাজ অল্প ক’জন আলেমের উপস্থিতিতে একটি সংহতি সমাবেশ করে। অভ্যুত্থান চলাকালে সারাদেশের আলেম সমাজের আর কোনো অরাজনৈতিক ব্যানার ছিল না। আমরাই প্রথম কারফিউর ভেতর ও আন্দোলনের সবচেয়ে হটস্পট যাত্রাবাড়ি এলাকায় ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামি। আমাদের সমাবেশ শেষে যখন মিছিল করি, তাতে সাধারণ মানুষও অংশ নেয়। মিছিল শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সেদিনের মতো মহাসড়ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আমরা দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই কয়েকটি পুলিশের গাড়ি, সেনাবাহিনী হাজির হয়। আমাদের সঙ্গে প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক হয়। কয়েকজন অতি উৎসাহী পুলিশ আমাদের থানায় নিয়ে ঠান্ডা করার হুমকি দেয়। তারা আমাদের দাঁড়াতেই দিচ্ছিল না। তবুও আমরা দাঁড়িয়েছি এবং সেখান থেকে মিছিল নিয়ে যাত্রাবাড়ি মোড় পর্যন্ত এসেছি। তখনকার পরিস্থিতিতে এমন সমাবেশে উপস্থিতি ভীষণ শঙ্কাজনকই ছিল! আমাদের এ সমাবেশ প্রচণ্ডরকম প্রভাব ফেলে। আমার কাছে তখন প্রচুর ম্যাসেজ এসেছিল। তারা এ সমাবেশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। মাদ্রাসার ছাত্রদের ভেতর ভীষণ রকম সাহসের সঞ্চার হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্ররা এবং তরুণ আলেমরা যোগাযোগ করেছিলেন।
আমরা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও যথাসম্ভব সমন্বয় করেছি। আমাদের সমাবেশের সূত্রে আন্দোলিত হওয়ার এ অনুভুতিগুলো তখন এবং পরবর্তীতে আমরা পেয়েছি। আমাদের সংহতি সমাবেশ এবং এর আগে হাটহাজারি ও চরমোনাই মাদ্রাসার ছাত্রদের মিছিল আলেম সমাজ ও মাদ্রাসামহলে অদৃশ্য ভয়ের দরজা ভেঙে দিয়েছিল। আমাদের ‘গাশত কর্মসূচি’ ছিল। এটি জনগণের মধ্যে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এবং রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি ধর্মীয় ও নৈতিক শক্তির সংহতিকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করে। আমাদের আহ্বান ছিল, প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে দলবদ্ধ হয়ে অথবা ব্যক্তিগতভাবে আশপাশের সব দ্বিধান্বিত মানুষকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য যে কোনো ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাবেন। মূলত আমরা যেহেতু অরাজনৈতিক এবং আলেম ও দাঈ সমাজের প্লাটফর্ম করেছিলাম, তাই আমাদের কর্মসূচিগুলো গতানুগতিক রাজনৈতিক না করে ধর্মীয় ও কালচারাল প্রতিনিধিত্বশীল করার চেষ্টা ছিল। এ ছাড়া আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য এবং বিশেষত লংমার্চে ঢাকামুখী মানুষের জন্য আমরা পানি, শরবত, শুকনো খাবার ইত্যাদি সরবরাহ করতাম।
আলোকিত বাংলাদেশ : একজন আন্দোলনকর্মী হিসেবে ২০১৩ সালের হেফাজত আন্দোলনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আশরাফুল হক : ১৩ থেকে ২৪ মূল্যায়নে সেকালে বাংলাদেশের শাসনভারের ভিত্তি বোঝা দরকার। কালচারাল গ্যাং, প্রশাসনিক গ্যাং, ব্যবসায় অলিগার্ক, হলুদ মিডিয়া, ভয় ও ত্রাসের সঞ্চারে পতিত সরকার টিকেছিল। তের এমন এক মহাকাণ্ড, যা একত্রে এ সবগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তের দেখিয়েছে, যে কালচারাল বয়ানের ওপর তারা দাঁড়িয়েছিল, গোটা বাংলাদেশের কোটি কোটি জনতা তা রাস্তায় নেমে প্রত্যাখ্যান করছে। গোটা প্রশাসন তৌহিদি জনতার জাগরণকে ধ্বংসলীলা চালানো ছাড়া রুখতে পারেনি। সরকারের হাতে যে ধনকুবেরা ছিল, মিডিয়ার অপপ্রচার ছিল, ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব ছিল, সবকিছুই খানখান হয়ে গেছে। এরপর অসৎ পথের গলিঘুপচি ছাড়া তেরকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো পদক্ষেপই সরকার নিতে পারেনি। সরকারের প্রতাপে সেই যে ধস নামতে শুরু করেছে, তা পরিপূর্ণ সেরে ওঠেনি আর। এজন্য হাসিনাকে সবসময় আলেম সমাজ বা তৌহিদি জনতার প্রতিনিধিদের বাগে রাখার চেষ্টা করতে হয়েছিল। তের শুধু হাসিনা নয়, বরং বাংলাদেশে যারাই যখন ধর্ম ও দেশ নিয়ে ছেলেখেলার চেষ্টা করবে, তাদের জন্যই বার্তাবাহক হয়ে থাকবে।
আলোকিত বাংলাদেশ : বিগত এক বছরের অন্তবর্তীকালীন বাংলাদেশ কেমন দেখলেন?
আশরাফুল হক : আশানুরূপ নয়। আমাদের আশা বেশি, তাই আশাভঙ্গ বেশি। এ বয়ানটিকে গা বাঁচানো বয়ান মনে হয়। এ সরকারের ভেতর অনেকগুলো পাওয়ার হাউজ আছে। যে কোনো সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের জায়গায় একেকটি পাওয়ার হাউজ একেক রকম স্বার্থ বাস্তবায়ন করতে চায়। আবার সরকারেরও স্বতন্ত্র কোনো শক্তিশালী নীতিগত বা দর্শনগত অবস্থান নেই। তাই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপগুলো হয়তো আটকে যায় বা ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হয় না। এভাবেই রাষ্ট্র সবদিক থেকে অস্থিতিশীল হয়ে আছে। বড় একটি শক্তি চায়, সরকারের সিদ্ধান্তগুলো নির্বাচনমুখী পরিবেশের সহায়ক হোক, আবার একটি শক্তি চায়, সরকারের পদক্ষেপগুলো নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশে বিঘ্ন ঘটাক, এ সরকারকে এভাবে রেখে নিজেদের আখের আরও ভালোভাবে গোছানোর অবকাশ তৈরি হোক। এ জায়গা থেকেই সরকারের অবস্থা টলমলে হয়ে আছে। আমার মনে হয়, সরকার প্রথমে যে ঘোষণা দিয়েছে, অর্থাৎ ছাব্বিশের জুন বা দেড় বছরের ভেতর নির্বাচন, এ সিদ্ধান্তে সরকারকে সহায়তা করা প্রয়োজন ছিল। সরকার যদি বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনকে সামনে রেখে দেড় বছরে কোনটা কতটুকু অগ্রগতি হবে, এমন একটি রোডম্যাপ তৈরি করে স্থির মাথায় রাষ্ট্র চালাতে পারত এবং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসনিক শক্তি সেখানে সহায়তা করত, তাহলে এ সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সরকারের কীর্তি ঘরে তুলতে পারত। কিন্তু তা হলো না। উল্টো সরকারের মেয়াদ নিয়ে একটি ধূম্রজাল তৈরি করা হলো। ফলে অনেক বড় বড় শক্তি সরকারের পাশ থেকে স্বাভাবিকভাবে সরে যেতে থাকল। সরকারও চাপে পড়তে লাগল। যে রাষ্ট্র রাজনৈতিক দলবদ্ধ শক্তির হাতে নিয়ন্ত্রিত, সেই রাষ্ট্রে একটি দলমুক্ত সরকার বিভিন্ন দলের সহায়তা ছাড়া চলতে পারার কথা নয়। কিন্তু এ সহায়তার হাতগুলো দিন দিন গুটিয়ে গেছে। এটা ঠিক হয়নি। এখন এমন একটি ভজকট পাকিয়ে গেছে, সরকারের ইতিবাচক দিকগুলো বলতেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ হচ্ছে না। কারণ, যে অবস্থাটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখব, কালই সেটি ভিন্ন পথে প্রবাহিত হতে পারে।
আলোকিত বাংলাদেশ : আলেমদের জন্য চেয়েছেন, পাননি; চাননি, পেয়েছেন- পতিত সরকার থেকে নতুন বাংলাদেশে কী কী দেখলেন?
আশরাফুল হক : আমরা চেয়েছিলাম ইসলামিক ফাউন্ডেশন কার্যকর হবে। রাষ্ট্রের জন্য এটি খুব প্রয়োজন ছিল। এ রাষ্ট্রের সিংহভাগ জনগণ মুসলমান। এ মুসলিম জনপদকে আপনি সম্পূর্ণরূপে ইসলামবিমুখ ও সাংঘর্ষিক জীবনধারায় চালাতে গেলে রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা চলমান থাকবে। ইফাকে কার্যকর করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামের বেসিক নলেজ, বিভিন্ন ধরনের কালচারাল মুভমেন্ট জোরালোভাবে চলমান থাকলে এ অস্থিতিশীলতা বহুলাংশে কমবে। কিন্তু তা হলো না। ইফা সেই আগের ইফাই রয়ে গেছে। চেয়েছিলাম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন আয়োজন সরকারি ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে, বৈষম্যহীন বাংলাদেশে রাষ্ট্র আলেম সমাজকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মূল্যায়ন করবে, জঙ্গি নাটক ও ইসলামোফোব দূরীকরণে পদক্ষেপ থাকবে, সংবিধান সংস্কারে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরে আসবে, জুলাই সনদে এ দেশের মানুষের প্রধান মূল্যবোধ তথা ইসলামাচার উচ্চারিত হবে, কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়ন হবে, বাইতুল মোকাররম সত্যিকারের জাতীয় মসজিদ হয়ে উঠবে, মডেল মসজিদগুলো ইসলামি সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে, কিন্তু কিছুই হয়নি। পাওয়ার মধ্যে পেয়েছি শুধু একজন খতিব।
আলোকিত বাংলাদেশ : সর্বস্তরের আলেম ও মুসলমানদের জন্য আগামীর বাংলাদেশ কেমন চান? তার সম্ভাবনা ও শঙ্কা কতটুকু?
আশরাফুল হক : আমরা এমন একটি দেশ চাই, যেখানে ন্যায়বিচার হবে রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। মানবিক মর্যাদা ও আধুনিক তাকওয়া রাষ্ট্রের আদলে নির্মিত হবে নেতৃত্ব। যেখানে যে যত উন্নত চরিত্রের হবেন, নেতৃত্বের সারিতে সে তত এগিয়ে থাকবেন। আইনের শাসন থাকবে সবার জন্য সমান। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। বহু ধর্মীয় সহাবস্থানের আদর্শিক নীতি বজায় রেখে কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে শাসন পরিচালিত হবে। গণহত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা হবে। আমরা সম্ভাবনা দেখতে ভালোবাসি। মনে করি, সব সম্ভাবনাই সবসময় শঙ্কার মুখে থাকে। শঙ্কা জয় করাই আন্দোলনকর্মীদের কাজ।