ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মসজিদভিত্তিক সমাজের আবশ্যিকতা

তাবাসসুম মাহমুদ
মসজিদভিত্তিক সমাজের আবশ্যিকতা

মসজিদ এমন একটি মিলনস্থল, যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন করে; পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বাড়ায়। জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়, সামাজিক অনুষ্ঠান, শিক্ষা ও সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে শক্তিশালী সামাজিক কাঠামো ও বন্ধন তৈরিতে মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই মসজিদ একটি জীবন্ত কেন্দ্র; যেখানে ঈমান আবির্ভূত হয়, হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়, আর সমাজ পায় তার পথের দিশা। একটি মুসলিম রাষ্ট্র যদি তার আত্মা খুঁজতে চায়, তবে তা মসজিদের অঙ্গনেই খুঁজে পাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন প্রথম যে কাজটি করলেন, তা ছিল মসজিদ নির্মাণ। এটি নিছক কোনো ধর্মীয় অবকাঠামো নির্মাণ ছিল না, বরং ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন। সেই মসজিদে নববি কেবল ইবাদতের স্থান ছিল না; ছিল শিক্ষাকেন্দ্র, রাজনৈতিক আলোচনার মজলিস, যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণের অঙ্গন, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্র এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে একতাবদ্ধ করার মহৎ এক কেন্দ্রবিন্দু। সেই আদর্শ আজ আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। মসজিদ এখন শুধু নামাজের জায়গা হয়ে যাচ্ছে।

মসজিদ মোমিন সমাজের প্রতিচ্ছবি : মসজিদের সঙ্গে আল্লাহর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহর জন্য। সুতরাং সেখানে আল্লাহ ছাড়া কাউকে আহ্বান করো না।’ (সুরা জিন : ১৮)। তাই নৈতিকতা, নেতৃত্ব, শিক্ষা, অর্থনীতিসহ সমাজের প্রতিটি দিকই এ প্রতিষ্ঠানের আলোয় গঠিত হওয়া উচিত। আল্লাহ বলেন, ‘একমাত্র তারাই আল্লাহর মসজিদগুলো আবাদ করবে, যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে।’ (সুরা তওবা : ১৮)। অর্থাৎ একটি জীবন্ত মসজিদ এক জীবন্ত ঈমানদার সমাজেরই চিত্র। যে সমাজ মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে, সেখানে মানুষের মাঝে আল্লাহভীতি জাগ্রত হয়। অন্যায় ও অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সমাজের প্রতিটি সদস্যের মাঝে আসে আত্মিক পরিশুদ্ধি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাতের প্রতিটি আজানই এক সামাজিক সংহতির বার্তা দেয়। যেখানে ধনী-গরিব, নেতা-জনতা, ব্যবসায়ী-শ্রমিক এক কাতারে দাঁড়ায়। এ সমতা শুধু ইবাদতের নয়, সমাজ গঠনেরও মজবুত ভিত্তি। যোগ্য লোক বাছাই করলে আর তাকে যথাযথ সুবিধা দিলে মসজিদের ইমাম শুধু নামাজ পড়ানোর দায়িত্ব পালন নয়; বরং তিনি হয়ে উঠতে পারেন সমাজের নৈতিক দিকনির্দেশক, শিক্ষাদাতা ও মানবিক নেতৃত্বের প্রতীক। এমনটি হলে সমাজে বহু অনৈতিকতা, দুর্নীতি ও পারিবারিক অবক্ষয় দূর হয়ে যাবে।

মসজিদ থেকে সমাজ বিচ্ছিন্ন : পরিতাপের বিষয়, আজ আমরা দেখি- মসজিদ থেকে সমাজ বিচ্ছিন্ন; আর সমাজ থেকে মসজিদ বিচ্ছিন্ন। মসজিদে শুধু ইবাদত হয়, আর সমাজ চলে পাশ্চাত্য চিন্তাধারায়। এ বিচ্ছিন্নতা এক অদৃশ্য আত্মাহীনতা সৃষ্টি করেছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা; যার প্রাণশক্তি হলো মসজিদ। সে প্রাণকে বাইরে রেখে কেবল আইন বা প্রশাসনের মাধ্যমে ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখা কল্পনা মাত্র। যদি মুসলিম রাষ্ট্রে মসজিদকে আবার সমাজব্যবস্থার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে সেই সমাজ থেকে ঈমানদার নাগরিক জন্ম নেবে, ন্যায়পরায়ণ প্রশাসক সৃষ্টি হবে, আদর্শ পরিবার গড়ে উঠবে। আল্লাহভীতি ও ইনসাফের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ভীত রচিত হবে। কারণ, যে রাষ্ট্রে মসজিদ জীবন্ত থাকে, সেখানে ঈমান ও হেদায়াতের আলোয় মানুষও জীবন্ত থাকে। আজকের মুসলিম বিশ্ব যেভাবে বিপর্যস্ত, বিভক্ত ও দিশাহীন-তাতে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে মসজিদকেন্দ্রিক পুনর্জাগরণ। তাই সমাজের প্রতিটি দিক, প্রতিটি সমস্যা, প্রতিটি দুর্বিপাকে মসজিদ হয়ে উঠুক আশ্রয় ও আলোকবর্তিকা। মসজিদ যদি শুধু শুক্রবারের জমায়েতেই সীমাবদ্ধ থাকে, আর রাষ্ট্র চালিত হয় পাশ্চাত্য ধাঁচে, তাহলে আমরা শুধু নামধারী মুসলিম রাষ্ট্র হব, প্রকৃত ইসলামি সমাজ গড়ে উঠবে না। মসজিদ হোক রাষ্ট্রের প্রাণ; মসজিদ হোক সমাজের আলো; মসজিদ হোক সেই আত্মিক ঘড়ি, যার কাঁটা সবসময় কেবলার দিকে।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত