ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

কালিমার শ্রেষ্ঠত্ব ও তাৎপর্য

শায়খ ড. আহমদ বিন আলি আল হুজাইফি
কালিমার শ্রেষ্ঠত্ব ও তাৎপর্য

সব উপদেশের মূল ও সব সাফল্যের আসল চাবিকাঠি আল্লাহর ভয় বা তাকওয়া অবলম্বন। তাকওয়াই হলো সব আমলের কেন্দ্রবিন্দু ও নিয়ন্ত্রণকারী, তাকওয়াই শুরু ও শেষ। যে ব্যক্তি জীবনের প্রতিটি সময়ে তাকওয়া অবলম্বন করে, সেই প্রকৃত সফল। মহাগ্রন্থ কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে যথার্থভাবে ভয় করো এবং আত্মসমর্পণকারী না হয়ে কোনো অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ কর না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০২)।

সর্বশ্রেষ্ঠ যে বিষয় দ্বারা হৃদয়গুলো ভরে ওঠে, অন্তর জীবন্ত ও সজীব হয়, জিহ্বা যাকে উচ্চারণ করে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যার দাবি অনুযায়ী কর্ম সম্পাদন করে, তা হলো ইখলাস ও তাওহিদের কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। এই কালিমার দ্বারা আল্লাহ নিজেই নিজের জন্য সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে উত্তম লোকদের মাধ্যমে সাক্ষ্য প্রদান করিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাসক নেই, ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানীগণও; আল্লাহ ন্যায়নীতিতে প্রতিষ্ঠিত, তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাসক নেই; তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮)। এটি সবচেয়ে মহান, সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ সাক্ষ্য। সর্বশ্রেষ্ঠ সাক্ষ্যদাতা ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাক্ষ্যবস্তুর সাক্ষ্য।

এই কালিমার ওপরই টিকে আছে আসমান-জমিন, এর কারণেই সৃষ্টি হয়েছে সমস্ত মাখলুক। এর জন্যই আল্লাহ রাসুলগণকে পাঠিয়েছেন, কিতাব নাজিল করেছেন ও শরিয়তের বিধান দিয়েছেন। এর জন্যই কেয়ামতের দিন ওজন করা হবে, হিসাবের খাতা রাখা হবে। এর জন্যই নির্ধারিত হয়েছে কাবার কিবলা, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দ্বীন। এ কালিমাই হলো ইসলাম ধর্মের ভিত্তি ও জান্নাতের দরজার চাবি। এই কালিমাই আল্লাহর একক অধিকার, যা তিনি সব মানুষকে মানতে বাধ্য করেছেন। কেয়ামতের দিন প্রথম ও শেষের সবাইকে এই কালিমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে। এর মানে হলো, কোনো মানুষ, যে মর্যাদারই হোক না কেন, তার সামনে ইবাদতের কোনো দিক নিবেদিত হতে পারে না। ইবাদত করার যোগ্য একমাত্র সেই সত্তাই, যিনি পূর্ণ প্রভুত্বের অধিকারী, আর তিনি একমাত্র আল্লাহ। কারণ তাঁর সত্তা, গুণাবলি, কাজকর্ম, নামের সবই পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ। আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু দুর্বল, অভাবী ও নির্ভরশীল। তাই একমাত্র আল্লাহই ইবাদতের যোগ্য।

যখন মানুষ এই মহান কালিমার অর্থ নিয়ে চিন্তা করে, তখন বুঝতে পারে যে, শুধুমাত্র এর মাধ্যমেই প্রকৃত মানবমুক্তি আসে। শুধু এর মাধ্যমেই মানুষ সব মাখলুকের দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়। কারণ মোমিন স্বীকার করে যে, সে এক আল্লাহরই ইবাদত করবে, তাঁর কাছেই মাথা নত করবে, তাঁরই সামনে হৃদয় ও শরীর ঝুঁকাবে। আল্লাহই সেই মহান সত্তা, যার সামনে হৃদয় নত হয়, এরপরে কপাল সেজদায় পড়ে, আর জিহ্বা ও ঠোঁট তাঁর একত্ব ও মহত্ত্বের কথা বলে।

এ কালিমা হলো সব নবীর দাওয়াতের সারসংক্ষেপ। আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হলো এই কালিমা। এতে একত্র হয়েছে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, নিয়ন্ত্রণকারী ও উপাস্য হওয়ার অনন্য গুণ। রুবুবিয়ত মানলে উলুহিয়ত মানতে হবে, আর উলুহিয়ত মানলে রুবুবিয়ত মানা অপরিহার্য হয়ে যাবে। যেমন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য না থাকার সাক্ষ্য পূর্ণ হয় না যতক্ষণ না এই দ্বিতীয় সাক্ষ্য যোগ করা হয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। কারণ, উপাসক মানে যার ইবাদত করা হবে, যাকে সর্বোচ্চ ভালোবাসা ও সম্মান দেওয়া হবে। আর আল্লাহর প্রকৃত ইবাদত তখনই সম্ভব, যখন মানুষ আল্লাহ যা ভালোবাসেন তা ভালোবাসবে, আল্লাহ যা অপছন্দ করেন তা অপছন্দ করবে। আর আল্লাহর ভালোবাসা ও অপছন্দ জানার একমাত্র পথ হলো তাঁর রাসুল মুহাম্মাদ (সা.)-এর আনুগত্য। তাই আল্লাহকে ভালোবাসা মানেই তাঁর রাসুলকে ভালোবাসা, তাঁর কথা মানা ও অনুসরণ করা।

জান্নাত চিরস্থায়ী সুখের ঘর। এর মর্যাদা খুব উচ্চ হওয়ায় মূল্যও অত্যন্ত বেশি। আর সেই মূল্য হলো, এই মহামূল্যবান কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। এর মানে হলো মহামহিম আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহতায়ালার রাসুল। অবশ্য শুধু মুখে বললেই নয়, বরং যখন এর অর্থ অন্তরে গেঁথে যায়, হৃদয় তা দিয়ে পূর্ণ হয়, অন্তর তার আলোতে আলোকিত হয়, তখনই এর আসল ফল পাওয়া যায়। আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন, ‘একবার মুআজ (রা.) নবী করিম (সা.)-এর পেছনে বাহনে ছিলেন, তখন তিনি তাকে ডাকলেন, হে মুআজ ইবনু জাবাল! মুআজ (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনার সার্বিক সহযোগিতা ও খেদমতে হাজির আছি। তিনি ডাকলেন, মুআজ! মুআজ (রা.) উত্তর দিলেন, আমি হাজির হে আল্লাহর রাসুল ও প্রস্তুত। তিনি আবার ডাকলেন, মুআজ। তিনি উত্তর দিলেন, আমি হাজির ও প্রস্তুত। এমন তিনবার করলেন। অতঃপর বললেন, ‘যেকোনো বান্দা আন্তরিকতার সঙ্গে এ সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসুল’ তার জন্য আল্লাহতায়ালা জাহান্নাম হারাম করে দেবেন। মুআজ বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি কি মানুষকে এ খবর দেব না, যাতে তারা সুসংবাদ পেতে পারে?’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তারা এর ওপরই ভরসা করবে।’ (বোখারি : ১২৮)।

আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘একবার আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, কেয়ামতের দিন আপনার সুপারিশ লাভের ব্যাপারে সবচেয়ে অধিক সৌভাগ্যবান কে হবে? আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘আবু হুরায়রা, আমি মনে করেছিলাম, এ বিষয়ে তোমার আগে আমাকে আর কেউ জিজ্ঞেস করবে না। কেননা, আমি দেখেছি হাদিসের প্রতি তোমার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। কেয়ামতের দিন আমার শাফাআত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান হবে সেই ব্যক্তি, যে একনিষ্ঠচিত্তে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস নেই বলে।’ (বোখারি : ৯৯)।

অতএব, তাওহিদের কালিমা শুধু ঠোঁট নড়ানোর জন্য সাধারণ কোনো শব্দ নয়, বরং এটি একটি বিশাল অর্থবহ কালিমা। এটি এমন এক বৃক্ষের মতো, যার ফল মিষ্টি ও সুফল সমৃদ্ধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি লক্ষ্য করো না আল্লাহ কীভাবে উপমা দিয়ে থাকেন? সৎবাক্যের তুলনা উৎকৃষ্ট বৃক্ষ- যার মূল সুদৃঢ় ও যার শাখা-প্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত- যা প্রত্যেক মওসুমে এর ফলদান করে এর প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। আর আল্লাহ মানুষের জন্যে উপমা দিয়ে থাকেন, যাতে তারা শিক্ষা গ্রহণ করে।’ (সুরা ইবরাহিম : ২৪-২৫)।

এই কালিমা হলো- এমন এক ছায়াময় বৃক্ষ, যেখানে জীবনের কষ্টে ক্লান্ত প্রাণ আশ্রয় নেয়। সে বৃক্ষ তার ফলগুলো সহজে কাছে টেনে দেয়, ছায়া মেলে ধরে। যখন এই কালিমার অর্থ অন্তরের গভীরে স্থায়ী হয়ে যায়, তখন হৃদয় শান্ত হয়, মন প্রশান্ত হয়, আত্মা স্বস্তি পায়। তখন বক্ষ প্রশস্ত হয় ও অন্তর প্রশান্ত হয়।

আজকের এই দ্রুতগামী জীবনে, যেখানে চারপাশে নানা প্রভাব ও দুঃখ-কষ্টের ঢেউ, সেখানে এই কালিমাই হয়ে ওঠে বিপর্যস্ত হৃদয়ের সান্ত¡না ও ভীত হৃদয়ের নিরাপত্তা। এটি হৃদয়ে বয়ে আনে গ্রীষ্মের দিনে শীতল বাতাসের মতো প্রশান্তি। যে হৃদয় তাওহিদে পূর্ণ, সে জীবনের ওঠাণ্ডনামায় স্থির থাকে। কারণ সে বিশ্বাস করে, তার এক মহান রব আছেন, যিনি সবকিছুর নির্দিষ্ট পরিমাণ ঠিক করেছেন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) বিপদাপদের সময় এই দোয়া করতেন, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি মহান ও সহনশীল; আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি মহান আরশের রব; আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি আসমানসমূহের রব, জমিনের রব মহিমান্বিত আরশের রব।’ অতএব, আসুন, আমরা জিহ্বা দিয়ে এই কালিমা বেশি বেশি পড়ি ও অন্তর দিয়ে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের তাওহিদের ওপর জীবিত রাখুন ও তাওহিদের কালিমার ওপর মৃত্যু দান করুন।

(২৮-০২-১৪৪৭ হিজরি মোতাবেক ২২-০৮-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগের মুহাদ্দিস- আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত