ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর লালা বরকতের উৎস

উবাইদুল্লাহ তারানগরী
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর লালা বরকতের উৎস

মুহাম্মদ (সা.)-এর লালা ছিল রহমতের আঁধার, বরকতের উৎস ও আরোগ্যের ওষুধ। আল্লাহর শেষ রাসুল, মানবজাতির ত্রাণকর্তা, শান্তির দূত, যার দেহের প্রতিটি অংশই ছিল আলো ও আশীর্বাদে পূর্ণ। তাঁর একটি অলৌকিক গুণ ছিল; লালার মাধ্যমে চিকিৎসা। মুহূর্তেই আরোগ্য ছুঁয়ে যেত সামান্য স্পর্শেই। এটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়; বরং সাহাবাদের জীবনে একে একে ঘটে যাওয়া এসব অলৌকিক মোজেজা আজও ঈমানি হৃদয়ে আলো ছড়িয়ে দেয়। নবীজির লালা, ঘাম, কেশরাশির মতো জিনিসগুলোকেও সাহাবিরা বরকতময় মনে করতেন।

আল্লাহতায়ালা তাঁকে বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা দিয়েছিলেন, যাতে তাঁর দোয়া ও স্পর্শে মানুষ সুস্থতা পেত। হাদিস ও সিরাতে এই বিষয়গুলো ‘মোজেযা’ নামে আলোচিত হয়েছে- যা নবীজির সত্যতা ও মর্যাদার প্রমাণ বহন করে। এই লেখায় নবীজির পবিত্র লালা নিয়ে কিছু আলোকপাত করা হলো-

চোখব্যথা উধাও : খাইবার যুদ্ধের প্রাক্কালে আলি (রা.) চোখের যন্ত্রণায় অস্থির। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতে তাকে ডাকা হলো, কিন্তু চোখের যন্ত্রণা তাকে দুর্বল করে রেখেছিল। নবীজি (সা.) তার চোখে নিজের লালা লাগালেন, আর দোয়া করলেন। মুহূর্তেই সব যন্ত্রণা ও পীড়া উধাও, দৃষ্টিশক্তি এমনভাবে ফিরে এলো- যেন কিছুই হয়নি। আলি (রা.) বলেন, ‘এরপর কখনো চোখে ব্যথা পাইনি।’ (বোখারি : ৪২১০; মুসলিম : ২৪০৫)।

চোখ ফিরে পায় আলো : আবু কাতাদা (রা.) সাহসী এক মুজাহিদ, যিনি উহুদের ময়দানে যুদ্ধরত অবস্থায় চোখ হারান। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। তার আর্তনাদ শুনে নবীজি (সা.) চোখটি নিজ হাতে উঠিয়ে জায়গায় বসান, এবং নিজের লালা তাতে মেখে দেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখটি আগের চেয়ে আরও উজ্জ্বল ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। সুন্দর ও তীক্ষè দৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষী, তিনি সেই চোখ নিয়েই জীবনের বাকি অংশ অতিবাহিত করেন। ঈর্ষান্বিত হয়ে অন্যরা হরিণী এই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকত। আর প্রশংসা করত। (আল-ইসতিআব ফি মারিফাতিস সাহাবা, খণ্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১১৪৬)।

তাহনিকের বরকতে : নবজাতককে নবীজির কাছে আনলে তিনি খেজুর চিবিয়ে তাতে নিজের লালা মিশিয়ে নবজাতকের মুখে দিতেন। এই সুন্নতকে বলা হয় তাহনিক। এটি ছিল এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক অভিষেক। ইবনে জুবায়ের, ইবনে আব্বাস (রা.) সহ বহু সাহাবি এই বরকত লাভ করেছিলেন। নবীজির লালায় মিশে থাকত দোয়া, ভালোবাসা ও ভবিষ্যতের জন্য অফুরন্ত আস্থা। (মুসলিম : ২১৪৫)। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো কোন বুজুর্গ কর্তৃক শিশুর তাহনিকের রীতি বিদ্যমান।

রক্তপাত বন্ধ : রক্তপাত বন্ধ হয় নবীজির বরকতময় লালায়। খায়বার যুদ্ধে সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) আহত হন। শুরু হয় শোনিত ধারা। নবীজি (সা.) তার ক্ষতস্থানে নিজের লালা লাগিয়ে দেন। কোনো ঔষধ বা ব্যান্ডেজ ছাড়াই ক্ষত শুকিয়ে যায়, আর তিনি বলেন, ‘তারপর কখনো আমি সেই জায়গায় ব্যথা অনুভব করিনি।’ (মুসনাদে আহমাদ : ১৬৫২২)।

কূপের পানি বদলে যায় নবীজির লালায় : মদিনায় অবস্থানকালে একবার রাসুল (সা.) সাহাবাদের একটি কূপে গিয়ে দাঁড়ালেন। সেই কুপের পানি ছিল অত্যন্ত কষা, দুর্গন্ধযুক্ত এবং তিক্ত। আশপাশের কেউই ওই পানি পান করতে চাইত না। সেই সময় নবীজি (সা.) কুপের পানি দেখলেন। তিনি একটু পানি হাতে নিলেন, নিজের মোবারক লালা মিশিয়ে তাতে ফুঁ দিলেন এবং তা কূপে ফেলে দোয়া করলেন। অলৌকিকভাবে, কুপের পানি হয়ে গেল মিষ্টি, সুগন্ধি আর বরকতময়!ম সাহাবাগণরা এতে খুবই আনন্দিত হলেন। এরপর থেকে তারা সেই পানি অজুর জন্য, পান করার জন্য এবং রোগীদের সুস্থতার জন্য ব্যবহার করতেন। পানির ঘ্রাণ এতটাই মনোরম ছিল যে, কেউ কেউ বলতেন- ‘এটা তো যেন মিশকের ঘ্রাণ!’ (দারেমি, ৯৬)। সেটি ছিল বুয়া বা রওমা কূপের ঘটনা।

কান নিরাময় : সাবিত ইবনে কাইস (রা.) এর কানে সমস্যা ছিল, শোনার অসুবিধা হতো। নবীজি (সা.) নিজের লালা দিয়ে দোয়া করে তার কানে লাগান। ফলে তার কানে শুনতে আর সমস্যা থাকেনি।

সৈনিকদের পানিশূন্যতায় নবীজির থুতু : একবার সফরের সময় সাহাবারা পানি না পেয়ে পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছিলেন। নবীজি (সা.) তাঁর থুতু একটি পাত্রে ফেলে তাতে পানি ঢালতে বলেন। ফলে সেই পানি প্রচুর হয়ে যায় এবং সবাই তৃপ্ত হয়ে পান করেন। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া)।

নবুয়তের অলৌকিকতা : এসব ঘটনা শুধু একটি শারীরিক সুস্থতা অর্জনের গল্প নয়- বরং নবুয়তের প্রমাণ। রাসুল (সা.)-এর লালা থেকে যদি শিফা আসতে পারে, তবে তাঁর বাক্য, নির্দেশ, দোয়া, তাসবিহ, তাহলিল, তাহাজ্জুদ সবই যে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত, তা বুঝে নিতে আর কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

আজ নবীজির লালা নেই, কিন্তু তাঁর সুন্নত আছে। তাঁর বলা দোয়া ও আমল আছে। যখন অসুস্থ হই, তখন তাঁর শিখানো দোয়া- ‘আল্লাহুম্মা রব্বান-নাস ইশফি’ বললে তা যেন সেই বরকতময় লালারই প্রতিফলন। তাঁর ভালোবাসায় মন জড়ালে, তাঁর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরলে আমরাও পেতে পারি সেই শিফার ধারা, অন্তত আত্মার জন্য। নবীজির লালা দিয়ে আরোগ্য পাওয়া এ এক জীবন্ত মোজেযা, আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীজিকে দেওয়া অলৌকিকতা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত