প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১০ অক্টোবর, ২০২৫
পুরো দ্বীন ও শরিয়তকে আকিদা, ইবাদত ও আনুগত্য- এ তিন শিরোনামে আলোচনা করা যায়। আকিদার আলোচনায় প্রথমেই আসে তাওহিদ প্রসঙ্গ। তাওহিদ মূলত তিন প্রকার। প্রথম প্রকার আল্লাহর সত্তাকেন্দ্রিক একত্ব এবং অদ্বিতীয়তা। অর্থাৎ আল্লাহ এমন এক বিদ্যমান স্বয়ম্ভু সত্তা, যার অস্তিত্বই শুধু অপরিহার্য। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্তা অপরিহার্য নয়। তাঁর সত্তা ছাড়া আর সব সত্তা সম্ভাব্য ও মুখাপেক্ষী। তেমনি আল্লাহর সত্তার হাকিকতবিশিষ্ট দ্বিতীয় কোনো সত্তা নেই। তিনিই একমাত্র অনাদি অনন্ত। আল্লাহর সত্তার ক্ষেত্রে সংযোজন-বিয়োজন, স্থান-কাল ও সীমা-পরিসীমা প্রযোজ্য নয়।
কালিমায়ে তাইয়িবার অন্তর্নিহিত অর্থ : দ্বিতীয় প্রকার আল্লাহর নাম ও গুণ পরিচয়-সংক্রান্ত তাওহিদ। আল্লাহর সত্তাগত গুণাবলি যেমন- জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা, চিরঞ্জিবতা, দেখাশোনা ও কথাবার্তা ইত্যাদি গুণ বৈশিষ্ট্যে তাওহিদ। তৃতীয় প্রকার আল্লাহর ক্রিয়াকর্মণ্ডসংক্রান্ত তাওহিদ, সৃজন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়তা। আরেক ভাষায় এটাকে সৃজন-প্রতিপালন-সংক্রান্ত তাওহিদ বলা হয়। অস্তিত্বহীনকে সৃষ্টি করা, গায়েবিভাবে প্রাকৃতিক জগৎ নিয়ন্ত্রণ করা, সবাইকে রিজিক দেওয়া, সুস্থতাণ্ডঅসুস্থতা এবং জীবন-মৃত্যু নির্ধারণ করা, দ্বীন-শরিয়ত দান এবং জান্নাত-জাহান্নামের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি এ ধরনের তাওহিদের একেকটি অংশ। এজন্য কালিমায়ে তাইয়িবার অন্তর্নিহিত মূল অর্থ হলো- আল্লাহ ছাড়া আর কেউ উপাস্য নয়, আল্লাহ ছাড়া কেউ স্বয়ম্ভু অপরিহার্য নয়, একমাত্র আল্লাহই স্বয়ম্ভু অপরিহার্য সত্তা। যেহেতু আল্লাহ ছাড়া জগতের আর সবকিছু সম্ভাব্য ও মুখাপেক্ষী, তাই তারা সৃষ্টি হওয়ার ক্ষেত্রে স্বয়ম্ভু অপরিহার্য সত্তা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। যেহেতু আল্লাহ স্রষ্টা, একমাত্র আল্লাহর মধ্যে সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও গুণ রয়েছে, তাই তিনিই শুধু মাবুদ, ইবাদতের উপযুক্ত। এজন্য এর পরিণত সরল অর্থ হলো- আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, একমাত্র আল্লাহই ইবাদতের উপযুক্ত।
ইবাদত ও আনুগত্যের সংজ্ঞা : কোনো সত্তার মাঝে সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও গুণ মান্য করে তাকে রাজিখুশি করার জন্য এবং নিজের প্রয়োজন পূরণের জন্য যে প্রার্থনামূলক কাজ করা হয়, তাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘ইবাদত’ বলে। যেমন- সেজদা করা, তওয়াফ করা, দোয়া করা, মানত করা, কোরবানি করা, কারো নামের ওজিফা পড়া ইত্যাদি। সৃষ্টিকর্তার গুণ সাপেক্ষ নয়, এমন ক্ষেত্রে কারো আদেশ-নিষেধ মান্য করে কাজ করাকে ‘আনুগত্য’ বা ‘নেককাজ’ বলে। পারিভাষিক ‘ইবাদত’ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর জন্য হতে পারে না। পক্ষান্তরে ‘আনুগত্য’ বা ‘নেককাজ’ আল্লাহর জন্য হয়,? রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য হয়, পিতামাতা ও শাসক-সর্দার প্রমুখের জন্যও হয়। লেনদেন, সামাজিকতা, চরিত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, জীবিকাণ্ডসন্ধান ইত্যাদিবিষয়ক শরিয়তের বিধিবিধান পালন পারিভাষিক অর্থে ইবাদতের মধ্যে পড়ে না। এগুলো আনুগত্যবাচক বিধান। শরিয়তের বিধান হিসেবে এগুলো পালন করাও জরুরি এবং নিয়ত থাকলে সওয়াবও হবে। কিন্তু এগুলো সরাসরি ইবাদত নয়। যদিও রূপকার্থে আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ ও নিয়তের কারণে এগুলোকেও ইবাদত বলা হয়ে থাকে। এসবের কিছু ইবাদত পর্যন্ত পৌঁছার মাধ্যম আর কিছু বিষয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য জাগতিক শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ, বৈষয়িক উন্নতি ও উৎকর্ষ।
ইবাদত ও আনুগত্যের মাঝে পার্থক্য : ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য আল্লাহর সামনে নিজের চরম ক্ষুদ্রতা ও চূড়ান্ত ভালোবাসা প্রকাশ করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালের সফলতা লাভ করা। কিন্তু আনুগত্যের ক্ষেত্রে দুনিয়াবি উপকারিতাই বড় বিষয়। ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত শিরক ও হারাম। কিন্তু আনুগত্য বা হুকুম পালন নবীর জন্য, এমনকি নবী ছাড়া অন্যদের জন্যও হতে পারে; বরং নবীর আনুগত্য করা ফরজ। ক্ষেত্রবিশেষে কাফের-ফাসেকের আনুগত্যও করতে হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসুলের আনুগত্য কর, আর (ধর্মীয় বা জাগতিক দিক থেকে) যারা আদেশ দানের অধিকারী, তাদেরও।’ (সুরা নিসা : ৫৯)। কিন্তু ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুই শরিক করো না।’ (সুরা নিসা : ৩৬)। মোটকথা, গুরুত্বের বিবেচনায় দীন ও শরিয়তের প্রথমবিষয় আকিদা, তার সঙ্গে ইবাদত। এরপর সচ্চরিত্র ও ব্যক্তিগত-পারিবারিক বিধানকেন্দ্রিক আনুগত্য। এরপর? আসে রাজনৈতিক আনুগত্য ও বিধিবিধান। আকিদা, ইবাদত ও আনুগত্যের এ স্তরবিন্যাস পাল্টে দেওয়া অনেক বড় বিদআত এবং চিন্তাগত বিচ্যুতি।
সৃষ্টিকর্তা ও শাসক এক কথা নয় : যিনি রব, তিনি উপায়-উপকরণের ঊর্ধ্বে থেকে সৃষ্টি করেন এবং গায়েবিভাবে সৃষ্টিজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাদের বিষয়টি এমন নয়। সুতরাং রাষ্ট্রের নিয়মণ্ডশৃঙ্খলা রক্ষাকারীকে প্রকৃতার্থে ‘রব’ বলা যায় না। উপাস্যের প্রধান অর্থ শাসক নয়। কারণ, আল্লাহর শাসক গুণ হলো কার্যত একত্ববাদের অনেক প্রকারের একটি। সুতরাং ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ যদি বলা হয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো বিচারক বা শাসক নেই, তবে এটা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর খণ্ডিত আংশিক অর্থ। কেননা, হাকিমের মাঝে সৃষ্টিকর্তার শক্তি ও গুণ থাকা জরুরি নয়। তাই হাকিমের ইবাদত হয় না, কেবল আনুগত্য হয়। সুতরাং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ- আল্লাহ ছাড়া কোনো শাসক বা বিচারক নেই, আনুগত্যের উপযুক্ত কেউ নেই- এ অর্থ দ্বারা আল্লাহর মূল মহত্ত জাহির হয় না; বরং আল্লাহর মহত্তকে খাটো করা হয়।
রাজনৈতিক আনুগত্য ইবাদত নয় : দ্বীন মানে ওহিআশ্রিত এমন নিয়মকানুন, যা মানুষের মনন ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে; সব যুগে যে নিয়মকানুন প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। সুতরাং দ্বীন মানে রাষ্ট্রকাঠামো বলা হলে দ্বীনের মূল মহিমা থাকে না। অনুরূপ ইবাদতের স্তর আনুগত্যবাচক আমলের ওপর। শরিয়তের বিধিবিধানের মাঝে যেগুলো ইবাদত, সেগুলো রাষ্ট্র থাকলেও করতে হয়, রাষ্ট্র না থাকলেও করতে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক আনুগত্য এমন নয়। সুতরাং ইবাদত আর রাজনৈতিক আনুগত্যকে গুলিয়ে ফেলা বিভ্রান্তিকর। রাজনৈতিক বিধিবিধান পালন করাকে মূল ইবাদত বলা এবং প্রকৃত ইবাদতকে রাজনীতির জন্য সহায়ক উপকরণ সাব্যস্ত করা বিকৃতি।
শেষ কথা : দ্বীন মানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো, ইলাহ বা উপাস্য মানে হুকুমকর্তা শাসক, রব মানে রাষ্ট্রীয় নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষাকর্তা, ইবাদত মানে রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে চলা- এ পরিভাষা চতুষ্টয়ের এমন রাজনীতিপ্রধান অর্থ নির্ধারণ বিভ্রান্তিকর। এ বিকৃতি রাজনীতিকেন্দ্রিক উগ্রতা ও খারেজিপনা জন্ম দেয়। এর ফলে কুফরি ফ্যাসাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমন রাজনীতিপ্রধান ধর্মচিন্তা থেকে সাবধান। পূর্বসূরি মুসলিম মনীষীরা এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। ধর্মীয় এ চিন্তাধারার দিকগুলো সমকালীন রাজনীতিকদের স্মরণ রাখা দরকার।
লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা