ঢাকা রোববার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনা শরিফের জুমার খুতবা

আল্লাহর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা

শায়খ ড. উসামা বিন আবদুল্লাহ খাইয়াত
আল্লাহর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা

আল্লাহতায়ালা বান্দার প্রতি অতি দয়াবান। তিনি বান্দাকে সীমাহীন ভালোবাসেন। সর্বদা দয়ার চাদরে ঢেকে রাখেন। নানা ধরনের নেয়ামতের মাধ্যমে তার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। সেসব নেয়ামতের মাঝে অন্যতম নেয়ামত, বান্দার প্রতি তাঁর আদেশগুলো- যা সর্বপ্রকার কল্যাণের ধারক, যার অনুসরণে আত্মা সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়, হৃদয় প্রশান্ত হয়, জীবন হয় স্বাচ্ছন্দ্যময়; যেগুলোর অনুসরণ নিয়ে আসে ইহ-পর উভয় কালের সুনিশ্চিত সাফল্য।

একটি আয়াত ও তিনটি উপদেশ : আল্লাহর আদেশসমূহের মাঝে তিনটি এমন বিশেষ আদেশ রয়েছে, উপকারের দিক দিয়ে যার তুলনা হয় না। হৃদয়ে যা স্থায়ী ও শক্তিশালীভাবে রেখাপাত করে। একটি আয়াত; তিনটি উপদেশ- যাতে সমাবেশ ঘটেছে আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে শরিয়তের সামগ্রিক নীতিমালার। কোনো ভালো কাজই তার আওতামুক্ত নয়। এমন কোনো মহৎ গুণ নেই, যার দিকে ওই তিনটি উপদেশের মাধ্যমে ইঙ্গিত করা হয়নি। সব সৃষ্টির সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে, কোন পন্থায় তাদের ওপর দয়া করতে হবে, কীভাবে তাদের সুখী করতে হবে; কীভাবে সৃষ্টির অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকা যাবে; তার সবই বলে দেওয়া হয়েছে উপদেশত্রয়ে। আল্লাহতায়ালা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল (সা.)-কে সম্বোধন করে বলেন, ‘সহজতা গ্রহণ করুন। সৎকাজের আদেশ করুন। মুর্খদের এড়িয়ে চলুন।’ (সুরা আরাফ : ১৯৯)।

প্রথম উপদেশ : আল্লাহতায়ালা প্রথমে সহজতা গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করেছেন। সামর্থ্যরে বাইরে মানুষের ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কথা হোক, বা কাজ- মানুষের জন্য যা সহজ হয়, তা-ই তার থেকে আশা করতে হবে। একেবারে পূর্ণ করতে হবে, যত কষ্টই হোক, চূড়ান্ত করে তবেই উঠতে হবে, এমন চাপ দেওয়া কিছুতেই উচিত নয়। মানুষের কষ্ট দূর করতে হবে। অসহনীয় কিছু কারও কাছ থেকে আবেদন করা যাবে না।

দ্বিতীয় উপদেশ : এরপর এসেছে সৎকাজে আদেশ করার কথা। কোরআনে এখানে ‘উরফ’ শব্দটি এসেছে। যার অর্থ, সেসব সৎকাজ যাকে বিশুদ্ধ বিবেক সুন্দর ও উপকারী বলে স্বীকৃতি দেয়। সর্বোত্তম সৎকাজ আল্লাহকে এক বলে মানা ও বিশ্বাস করা। এরপর আল্লাহ যা আদেশ করেছেন বা যা করার প্রতি আহ্বান করেছেন, তা করা। যে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তার সঙ্গে সম্পর্কজুড়ে রাখা; যে বঞ্চিত করে, তাকে দান করা; যে জুলুম করে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ সৎকর্মসমূহের অন্তর্ভুক্ত।

তৃতীয় উপদেশ : মূর্খরা মানুষকে কষ্ট দেবেই। এটি ঠেকানোর কোনো পথ নেই। এ জন্য এখানে তৃতীয় উপদেশটি দেওয়া হয়েছে মূর্খদের এড়িয়ে চলার ব্যাপারে। নিজের ক্রোধ প্রশমিত করার জন্য বা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মূর্খদের মূর্খতাকে অনুরূপ আচরণ দ্বারা মোকাবিলা করা যাবে না। তাদের দেওয়া কষ্টে ধৈর্যধারণ করতে হবে। এটাই উত্তম আদর্শ। রাসুল (সা.) এ কর্মপন্থাই গ্রহণ করেছিলেন। শত্রু হোক বা বন্ধু সবার ব্যাপারে এটাই রাসুল (সা.)-এর নীতি ও আদর্শ।

ইবনুল কায়্যিম (রহ.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি : ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, যারা সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহকে ডাকে ও তাঁর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করে, আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে তাদের ব্যাপারে ধৈর্যধারণের আদেশ করেছেন, তাদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে নিষেধ করেছেন। আদেশ করেছেন তাদের ক্ষমা করতে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে। তাদের কেউ যদি আল্লাহর অবাধ্যতা করে, যুদ্ধ থেকে বিরত থাকে; তওবা করার আগ পর্যন্ত তাকে এক ঘরে করে রাখারও নির্দেশ দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাসুল (সা.) এক ঘরে করেছিলেন সেই তিন ব্যক্তিকে, যারা তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছিল। কেউ দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়ার মতো অপরাধ করলে, ধনী হোক বা দরিদ্র, উঁচু হোক বা নিচু, রাসুল (সা.) তার ওপর শরয়ি শাস্তি প্রয়োগ করতে আদিষ্ট ছিলেন।

আল্লাহতায়ালা মানব-শয়তানকে একভাবে মোকাবিলার আদেশ করেছেন, জিন-শয়তানকে অন্যভাবে। মানব-শয়তানকে মোকাবিলার আদেশ করেছেন উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে। দুর্ব্যবহারের মোকাবিলা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। মূর্খতার মোকাবিলা ধৈর্যের মাধ্যমে। জুলুমের মোকাবিলা ক্ষমার মাধ্যমে। সম্পর্ক ছিন্নের মোকাবিলা সম্পর্কজুড়ে রাখার মাধ্যমে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, যদি এভাবে মোকাবিলা করা হয়, শত্রুও তাহলে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে রূপান্তরিত হবে। অন্যদিকে জিন-শয়তানকে মোকাবিলার আদেশ করেছেন আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে। কোরআনুল কারিমের তিনটি স্থানে আল্লাহতায়ালা মানব ও জিন-শয়তানের মোকাবিলার পন্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সহজতা গ্রহণ করুন। সৎকাজের আদেশ করুন। মূর্খদের এড়িয়ে চলুন। যদি শয়তনের কুমন্ত্রণা আপনাকে প্ররোচিত করার উপক্রম হয়, তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করুন; তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আরাফ : ১৯৯-২০০)। আল্লাহতায়ালা মূর্খদের অনিষ্ট থেকে বাঁচার পন্থা হিসেবে তাদের এড়িয়ে চলার আদেশ করেছেন। আর জিন-শয়তানের অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আদেশ করেছেন তার কাছে আশ্রয় চাইতে। পাশাপাশি এ আয়াতের মাঝে আল্লাহতায়ালা উত্তম চরিত্রের সামগ্রিক নীতিমালারও সমাবেশ ঘটিয়েছেন।

সৎলোকদের তিনটি পরিস্থিতি : আনুগত্যশীল বান্দারা সাধারণ মানুষের থেকে তিনটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারেন। কখনও তাদের কাছে কিছু পাওনা থাকতে পারে, যা তাদের ওপর আদায় আবশ্যক। কখনও তাদের কোনো বিষয়ের আদেশ করার প্রয়োজন পড়তে পারে। কখনও আবার তাদের পক্ষ থেকে তিনি অযাচিত কোনো পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। যখন সাধারণ মানুষ থেকে অধিকার আদায়ের প্রসঙ্গ আসবে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার আদেশ হলো, তাদের ওপর সহজ করতে হবে। যতটুকু আদায় করা তাদের জন্য আসান হয়, তাদের জন্য কষ্টকর না হয়, সহজে আদায় করতে পারে; তাদের থেকে ততটুকুই গ্রহণ করতে হবে। এটাকেই কোরআনের পরিভাষায় ‘আফউন’ বা সহজতা বলা হয়েছে; যা আদায় করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ কোনো ক্ষতি বা কষ্টের সম্মুখীন হয় না। আর যখন তাদের কোনো বিষয় আদেশ করার প্রসঙ্গ আসবে, তখন আল্লাহতায়ালার হুকুম হলো, তাদের সৎকাজের আদেশ করতে হবে। পাশাপাশি আদেশটাও করতে হবে ন্যায়সঙ্গতভাবে, কঠোরতাবিবর্জিত কোমল ভাষায়। আর সৎলোকরা যখন মূর্খদের কোনো মূর্খতাসুলভ আচরণের সম্মুখীন হবে, তখন বিষয়টি এড়িয়ে যাবে। মূর্খতাকে অনুরূপ মূর্খতা দ্বারা মোকাবিলা করতে যাবে না। এভাবেই তাদের অনিষ্ট থেকে হেফাজতে থাকা যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, হে আমার রব! যদি আপনি যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা দেখাতে চান, হে আমার রব! তবে আমাকে জালেম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করবেন না। নিশ্চয় আমি যার ওয়াদা করেছি, তা তোমাকে দেখাতে সক্ষম। তুমি মন্দের প্রতিরোধ করো তার চেয়ে উত্তম পন্থায়। তারা যা বলে, সে সম্পর্কে আমি পূর্ণ অবহিত। বলো, হে আমার রব! আমি শয়তানের প্ররোচনা থেকে আপনার আশ্রয় কামনা করছি। আপনার আশ্রয় কামনা করছি তাদের উপস্থিত হয়ে যাওয়া থেকে।’ (সুরা মোমিনুন : ৯৩-৯৮)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘ভালো-মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে উত্তম পন্থায় প্রতিরোধ করুন। তাহলে আপনার সঙ্গে যার শত্রুতা আছে, সে অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হবে। ধৈর্যশীলদেরই এ গুণের অধিকারী করা হয়ে থাকে। যারা মহাভাগ্যবান, তারাই এ গুণ লাভ করে। যদি শয়তান কখনও কুমন্ত্রণা দ্বারা আপনাকে প্ররোচিত করার উপক্রম হয়, তাহলে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করুন। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা হামিম সাজদা : ২৪-২৬)।

মানব, জিন, মোমিন, কাফেরসহ জমিনের সবার সঙ্গে এটাই ছিল রাসুল (সা.)-এর আদর্শ। এসব ক্ষেত্রে তিনিই একমাত্র পথপ্রদর্শক। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মাঝে যারা আল্লাহর কাছে পরকালে কল্যাণ প্রত্যাশা করে ও অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মাঝেই রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ (সুরা আহযাব : ২১)।

মূর্খদের এড়িয়ে চলার উপায় : মূর্খদের এড়িয়ে চলার উপায় হচ্ছে, তাদের সংসর্গ ত্যাগ করা; তাদের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত না হওয়া। তাদের কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য এর চেয়ে কার্যকরী কোনো দাওয়াই নেই; তাদের শত্রুতা প্রতিরোধের এর চেয়ে উত্তম কোনো উপায় নেই। এড়িয়ে চলাটা তাদের হৃদয়ে খুব রেখাপাত করে। তাদের এড়িয়ে চলার কারণ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘তারা সত্যকে হারিয়ে ফেললে আর খোঁজে না। যদি পেয়েও যায়, মনমতো না হলে তা গ্রহণ করে না। তারা অঙ্গীকারের প্রতি লক্ষ্য করে না। ভালোবাসার দাম দেয় না। সরাসরি উপকারে না এলে কোনো দানের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে না। দান বন্ধ হয়ে গেলে কৃতজ্ঞতা অকৃতজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। প্রশংসা নিন্দায় পরিণত হয়। মিলন পরিণত হয় বিচ্ছেদে, আর ভালোবাসা বিদ্বেষে। অতএব, সব ক্ষেত্রে কল্যাণ লাভের জন্য আল্লাহর উপর্যুক্ত আদেশেরই অনুসরণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সহজতা গ্রহণ করো। সৎকাজের আদেশ করো। আর মূর্খদের এড়িয়ে চলো।’ (সুরা আরাফ : ১৯৯)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুফতি মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত