প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫
রাজধানী ঢাকা আবার জ্বলল। অট্টালিকার ছায়া ছাড়িয়ে গেল আতঙ্কের আগুন। ফায়ার সার্ভিসের সাইরেন বাজল। পুলিশের গাড়ি ছুটে এল। আগুনও শেষমেশ নিভে গেল। কিন্তু প্রশ্নগুলো থেকে গেল- কে জ্বালায়? কেন জ্বলে এ শহর? ‘লকডাউন’ শব্দটি ক্রমেই রাজনৈতিক আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে উঠছে। যখনই এ শব্দ উচ্চারিত হয়, সাধারণ মানুষ ভাবতে শুরু করে- রাস্তা বন্ধ হবে, দোকানপাট জ্বলবে, গণপরিবহন পুড়বে আর জীবিকার চাকা থেমে যাবে। অথচ ইসলাম এমন কোনো কর্মকে কখনোই অনুমোদন দেয়নি, যা অন্যের জানমাল ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলিম অন্য মুসলিমের ওপর তার রক্ত, সম্পদ ও সম্মান নিষিদ্ধ।’ (মুসলিম : ২৪৭৩২)।
সহিংসতার পুরোনো চেনা মুখ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অগ্নিসন্ত্রাস কোনো নতুন ঘটনা নয়; বরং এটি যেন এক অভিশপ্ত ঐতিহ্য, যা ভোটের আগে, আন্দোলনের উত্তাপে বা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে বারবার ফিরে আসে। স্বাধীনতার পর থেকে নব্বইয়ের হরতালের দিনগুলো পর্যন্ত, এমনকি সাম্প্রতিক বছরগুলোর সংঘাতেও বাস পোড়ানো, গাড়ি ভাঙচুর, সড়ক অবরোধ যেন প্রতিবাদের এক পরিচিত ভাষা। কখনও এটি প্রতিরোধের প্রতীক, কখনও প্রতিশোধের অস্ত্র হয়। তবে সাম্প্রতিক দৃশ্যপট কিছুটা ভিন্ন। আগুনের উৎস অজানা, দাবি নেই, দায় স্বীকার নেই, তবু শহর জ্বলছে। ভয়, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের মনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মতে, এসব ঘটনা পরিকল্পিত নাশকতা, যা রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণেই হচ্ছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, দুর্বৃত্তরা গাড়ি পোড়াচ্ছে। কিন্তু এ দুর্বৃত্ত কারা? প্রশাসন কি এদের চিহ্নিত করতে পারে না? ইসলাম তো এদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দিতে বলেছে। কিন্তু আমরা এর প্রতি কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি? এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সুরা মায়িদা : ৩৩)।
লকডাউনের সার্বিক বিপর্যয় : একদিনের লকডাউন সারাদেশের চিত্র পরিবর্তন করে দেয়। অফিস ও কর্মস্থল বন্ধ হয়। জীবিকার চলমান চাকা হঠাৎ থমকে যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও খুচরা দোকান নীরব হয়। স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলে শিক্ষার আলো অন্ধকারে হারিয়ে যায়। দিনমজুর, রিকশা-অটোচালক ও অস্থায়ী উপার্জনকারীদের আর্থিক সংগ্রাম ব্যাহত হয়। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা সীমিত হওয়ার ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অস্থিরতা বেড়ে যায়। শহরের রাস্তাঘাটে ব্যাপকহারে গণপরিবহনে আগুন ও ক্ষতি তো রয়েছেই। এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় এক অদৃশ্য আতঙ্ক, বেড়ে যায় সামাজিক ও মানসিক চাপ; ইসলাম যা কোনোক্রমে সমর্থন করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি থেকে বিরত থাক। আল্লাহ ফাসাদকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা কাসাস : ৭৭)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘বিনা কারণে যে অন্যকে হত্যা করে, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে কারোর জীবন বাঁচাল, সে যেন সমগ্র মানবজাতির জীবন বাঁচিয়েছে।’ (সুরা মায়িদা : ৩২)।
সাধারণ নাগরিকের ভয় আর কাটে না : প্রতিটি আগুনের পর চিত্র প্রায় একই- পুলিশের ব্রিফিং, ফায়ার সার্ভিসের ছবিতে ভরা সংবাদপত্র, টেলিভিশনের টকশো, কয়েকদিনের তীব্র আলোচনা; তারপর ধীরে ধীরে সব থেমে যায়, শহর আবারও তার স্বাভাবিক যান্ত্রিক ছন্দে ফিরে আসে। আহ, কিন্তু আমরা কি সত্যিই স্বাভাবিক? যে সমাজে রাতের বেলায় বাসে উঠতে ভয় লাগে, যেখানে গাড়ি পার্ক করে রেখে মানুষ অস্থির হয়ে থাকে, সে সমাজের মানসিক স্থিতি কতটা দৃঢ়? কোনো জায়গাতেই আমরা আজ নিরাপদে নেই। এরপরও আমরা নিজেদের বুক ফুলিয়ে মুসলিম দাবি করি। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমানের হাত ও জিহ্বা অন্য মুসলিমকে নিরাপদ রাখে, সে প্রকৃত মুসলিম।’ (বুখারি : ১০)।
আমাদের বিবেকের পরীক্ষা : ঢাকা শুধু জ্বলে না, এটি আমাদের সামাজিক বিবেকের কঠিন পরীক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিটি আগুন যেন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়- আমরা কি এখনও একে অপরের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবি? আমরা কি সত্যিই এ শহরকে ভালোবাসি নাকি শুধু নিজের স্বার্থরক্ষার নামেই ভালোবাসা বলি? ভালোবাসা মানে ধ্বংস নয়। যাকে ভালোবাসি তাকে জোর করে নিজের দখলে আনা, প্রয়োজনে তাকে আঘাত করা, এটা ভালোবাসা নয়; বরং হিংসা ও ক্ষমতার বিকৃতি। দেশের সম্পদ জ্বালিয়ে, মানুষের জীবন বিপন্ন করে কেউ কখনও দেশকে ভালোবাসতে পারে না। প্রকৃত দেশপ্রেম মানে মানুষ, প্রতিষ্ঠান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করা। সত্যিকারের ভালোবাসা কখনও আগুনে নয়, সংলাপে, সহনশীলতায় আর সম্মিলিত দায়িত্ববোধে জন্ম নেয়।