প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২১ নভেম্বর, ২০২৫
সৃষ্টির অস্তিত্বের উদ্দেশ্য স্রষ্টার দাসত্ব। সৃষ্টির কাজ স্রষ্টাকে চেনা-জানা, তাঁর নাম-গুণ ও কর্ম সম্পর্কে অবহিত হওয়া। দাস তার মনিবকে যতটা জানবে, তাঁর সম্পর্কে তার বিশ্বাস ততটা বাড়বে। সে তাঁকে ভালোবাসবে। আনুগত্য করবে। তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ সুউচ্চ, সুমহান। এ গুণ দুটি তার আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত। তিনি সবার ওপরে, সবচেয়ে বড়। তিনি নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি দৃশ্য-অদৃশ্যের জ্ঞাতা, সুমহান ও সর্বোচ্চ মর্যাদাবান।’ (সুরা রাদ : ৯)। তিনি আরও বলেন, ‘এটা এ কারণে, তিনিই সত্য। তাঁকে ছাড়া তারা আর যাদের ডাকে, সব ভ্রান্ত। নিশ্চয় আল্লাহই সমুচ্চ, সুমহান।’ (সুরা হজ : ৬২)। অন্য আয়াতে বলেন, ‘তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামে পবিত্রতা ঘোষণা করো।’ (সুরা আলা : ১)।
তিনি পবিত্র-সুমহান : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুল (সা.) মিম্বরে উঠে তেলাওয়াত করলেন, ‘তারা আল্লাহর যথাযথ সম্মান করেনি। কেয়ামতের দিন সমগ্র ভূলোক থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয়। আসমানগুলো ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর অধীনে। তিনি পবিত্র, মহান। তারা যেসব জিনিসকে শরিক করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।’ (সুরা যুমার : ৬৭)। এরপর তিনি বলেন, আল্লাহতায়ালা সেদিন বলবেন, ‘আমিই পরাক্রমশালী। আমিই মহিমান্বিত। আমিই রাজাধিরাজ। আমিই সর্বোচ্চ।’ এভাবে তিনি নিজের মহিমা ঘোষণা করবেন। ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এ বাক্যগুলো বারবার বলেই যাচ্ছিলেন। মিম্বর কেঁপে কেঁপে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, যেন মিম্বর রাসুল (সা.)-কে নিয়ে হেলে পড়বে। (মুসনাদে আহমদ)।
তিনি আল্লাহ। সুমহান। তাঁর নামগুলো মহিমাময়। সত্তাগতভাবে তিনি সর্বোচ্চ, গুণগতভাবেও। সবকিছু তার অধীনস্থ। তিনি সর্বোচ্চ, তাঁর চেয়ে উচ্চে কেউ নেই। তিনি পবিত্র। আসমানসমূহের ওপরে আরশে সমাসীন। (এর প্রকৃত স্বরূপ সৃষ্টির অবোধগম্য। তিনি যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই আছেন। এর দ্বারা আল্লাহর মর্যাদাগত উচ্চতা ও কর্তৃত্ববান হওয়াও উদ্দেশ্য হয়ে থাকে)। তিনি সৃষ্টি থেকে বিযুক্ত। তবে জ্ঞান ও ইচ্ছের মাধ্যমে সৃষ্টির সঙ্গেই আছেন। তিনি সব সৃষ্টিকে আপন কর্তৃত্বে ঘিরে রেখেছেন। সৃষ্টিজগতের ওপর তাঁরই আদেশ কার্যকর হয়। সবকিছু তাঁরই ক্ষমতাধীন। কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টির বাইরে নেই। কিছুই তাঁকে অক্ষম করতে পারে না।
নৈকট্য ও সমুন্নতি : নৈকট্য ও সমুন্নতি দুটি গুণ। দুটিই আল্লাহর জন্য কোরআন-সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। এর কোনো একটি অপরটিকে নাকচ করে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তার মতো কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা শুরা : ১১)। আল্লাহতায়ালা নিজের সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি আসমান-জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। এরপর আরশে সমাসীন হন। ভূগর্ভে যা প্রবেশ করে, যা তা থেকে বের হয়, আসমান থেকে যা নেমে আসে, যা আসমানে উত্থিত হয়, তিনি সব জানেন। তোমরা যেখানেই থাকো, তিনি তোমাদের সঙ্গে থাকেন। তোমরা যা করো, আল্লাহ তা দেখেন।’ (সুরা হাদিদ : ৪)। মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘তুমি কি দেখো না, আল্লাহ আসমান-জমিনে যা কিছু আছে, তা জানেন। তিনজনে কোনো গোপন পরামর্শ হলে, তিনি সেখানে চতুর্থজন হিসেবে থাকেনই। পাঁচজনে হলে, তিনি ষষ্ঠজন হিসেবে কিংবা তার কম-বেশি হলেও তারা যেখানে থাকুক, তিনি তাদের সঙ্গে থাকেন। এরপর তিনি কেয়ামতের দিন তাদের কর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন।’ (সুরা মুজাদালা : ৭)।
ব্যাপক নৈকট্য ও বিশেষ নৈকট্য : এটি আল্লাহতায়ালার ব্যাপকার্থক কাছে থাকা। এ নৈকট্য সব সৃষ্টির বেলায় প্রযোজ্য। আরেকটা আছে বিশেষ নৈকট্য; যা তিনি দিয়ে থাকেন নবী-রাসুল ও নেককার বান্দাদের। তিনি তাদের সাহায্য করেন। শক্তি যোগান। ভালোবাসেন। সৎকাজের সুযোগ করে দেন। সঠিক পথ দেখান। বিপদে রক্ষা করেন। যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন। মুসা ও হারুন (আ.)-কে আল্লাহ ফেরাউনকে সৎপথে আহ্বানের আদেশ দিলেন। তারা বললেন, ‘হে আমাদের রব! আমরা তার থেকে আমাদের ওপর সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ির আশঙ্কা করছি।’ তিনি বলেন, ‘তোমরা ভয় কোরো না, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আমি দেখি ও শুনি।’ (সুরা তহা : ৪৫-৪৬)। অর্থাৎ আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। তোমাদের হেফাজত করব। শক্তি যোগাব। রবের ওয়াদা পেয়ে তাদের হৃদয় শান্ত হলো।
ফেরাউন সসৈন্যে মুসা (আ.) ও তার জাতিকে ঘিরে ফেলল। মুসা (আ.)-এর সঙ্গীরা মনে করল, তাদের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা বলল, ‘নিশ্চয় আমরা ধৃত হব।’ (সুরা শুআরা : ৬১)। মুসা (আ.) পূর্ণ প্রত্যয়ের সঙ্গে, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের প্রতি সুধারণার ভিত্তিতে বললেন, ‘কিছুতেই নয়। নিশ্চয়ই আমার রব আমার সঙ্গে আছেন। তিনি আমাকে মুক্তির পথ দেখাবেন।’ (সুরা শুআরা : ৬১)। আল্লাহ কারও সঙ্গে থাকলে, আল্লাহর সাহায্যও তার সঙ্গে থাকে। তিনি তাকে পথ দেখান। আত্মবিশ্বাসী করেন। বাঁধা ডিঙানোর শক্তি দেন। আল্লাহতায়ালা আমাদের নবী (সা.)-কে বলেন, ‘ধৈর্যের সঙ্গে আপন রবের আদেশ পালন করে যাও। তুমি আমার দর্শনেই আছ।’ (সুরা তুর : ৪৮)। অর্থাৎ তুমি আছ আমার চোখের সামনে, আমারই সংরক্ষণে, আমারই আশ্রয়ে। আমি তোমাকে দেখে রাখি, ঘিরে রাখি, পাহারা দিই। তুমি আছ আমার সামনেই। রাসুল (সা.) আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করতেন। তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা ও তত্ত্বাবধান উপলব্ধি করতেন।
হিজরতের সময়ের কথা। রাসুল (সা.) গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। মুশরিকরা গুহার মুখে দাঁড়ানো। আবু বকর (রা.) বললেন, ‘ওরা কেউ পায়ের দিকে তাকালেই তো আমাদের দেখে ফেলবে!’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘যেই দুজনের তৃতীয়জন আল্লাহ, তাদের ব্যাপারে তোমার ধারণা কী?’ এ ঘটনার কথা আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করে বলেন, ‘তোমরা তাকে সাহায্য না করলেও আল্লাহ তাকে অবশ্যই সাহায্য করেছিলেন। যখন কাফেররা তাকে বের করে দিয়েছিল, তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন। তারা দুজন ছিল গুহায়। এরই মধ্যে তার সঙ্গীকে বললেন, বিষণ্ণ হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা তওবা : ৪০)।
আসল দুঃখ : আল্লাহ যদি কারও সঙ্গে না থাকে, আর সে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে থাকে, আসল দুঃখের বিষয় মূলত সেটাই। আল্লাহর নৈকট্যের অনুভব হৃদয়ে শান্তি আনে, স্থিতি সৃষ্টি করে। হৃদয় থেকে দূর করে ব্যথা-বেদনার ভার। ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘যে আল্লাহর মারেফাত লাভ করে, সে অবশ্যই তাঁকে ভালোবাসে। যে আল্লাহকে ভালোবাসে, তার হৃদয়ের আঁধার বিদূরিত হয়। মন থেকে ব্যথা-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট বিলোপিত হয়। হাসি-আনন্দে মনের ঘর আবাদ হয়। চারদিক থেকে অভিনন্দন আর সুসংবাদ লাগাতার আসতে থাকে। কারণ, আল্লাহ সঙ্গে থাকলে কোনো কষ্ট থাকতে পারে না। সর্বোত্তভাবে দুঃখী তো সেই, যে আল্লাহকে হারিয়েছে। যে আল্লাহকে পেয়েছে, তার আর বেদনা কীসে? যে আল্লাহকে হারিয়েছে, তার আবার খুশি কীসে?’
বিশেষ নৈকট্য লাভের কয়েকটি উদাহরণ : আল্লাহর বিশেষ নৈকট্য পেয়েছেন ইবরাহিম (আ.)। যখন তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হলো, আল্লাহ বললেন, ‘হে আগুন! ইবরাহিমের জন্য ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া : ৬৯)। আরও পেয়েছেন ইউনুস (আ.)। যখন তিনি সমুদ্র তলদেশে মাছের পেটে ত্রি-স্তরের অন্ধকারে ছিলেন। আল্লাহতায়ালা তার অবস্থা তুলে ধরে বলেন, ‘সে সেই ঘোর অন্ধকার থেকেই ঘোষণা দিলো, তুমি ছাড়া কোনো রব নেই। তুমি পবিত্র; আমিই অপরাধী ছিলাম।’ (সুরা আম্বিয়া : ৮৭-৮৮)।
আল্লাহ যেভাবে তাঁর নবী-রাসুলদের সাহায্য করেছেন, সেভাবে তাদের অনুসারীদেরও করবেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি আমার রাসুলগণ ও তাদের অনুসারীদের পার্থিব জীবনে সাহায্য করব। সাহায্য করব সেদিনও, যেদিন সাক্ষীরা দণ্ডায়মান হবে।’ (সুরা মোমিন : ৫১)। এ কারণে মোমিন নারী-পুরুষ বিপদে আল্লাহরই আশ্রয় গ্রহণ করে। সবকিছু তাঁরই কাছে ন্যস্ত করে। তাঁর নৈকট্য হৃদয়ে অনুভব করে। তাঁর দয়া-অনুগ্রহের আশ্বাসে ভয় কেটে যায়। ইবরাহিম (আ.) স্ত্রী হাজেরাকে এক বিজন ভূমিতে রেখে যাচ্ছেন। যেখানে কোনো ফসল নেই। পানি নেই। সাথী-সঙ্গী নেই। হাজেরা বললেন, ‘আমাদের এ জনমানবহীন প্রান্তরে রেখে আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’ বারবার বলার পরও ইবরাহিম (আ.) সামান্য ভ্রুক্ষেপ করলেন না। হাজেরা বললেন, ‘আল্লাহতায়ালাই কী এরূপ আদেশ করেছেন?’ তিনি মাথা নাড়ালেন। হাজেরা (আ.) আনন্দ চিত্তে বললেন, ‘তাহলে আর তিনি আমাদের ধ্বংস করবেন না।’
মোমিন হৃদয়ে আল্লাহর নৈকট্যের অনুভব : নিদ্রা-জাগরণে, সকালে-সন্ধ্যায় মোমিন আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করে। সকালে সে বলে, ‘আমাদের সকাল হয়েছে। সকাল হয়েছে আল্লাহর বিশাল রাজত্বে।’ সন্ধ্যায় সে বলে, ‘সন্ধ্যা নেমেছে। সন্ধ্যা নেমেছে আল্লাহর বিশাল সাম্রাজ্যে।’ ঘুমের জন্য বিছানায় পিঠ রেখে বলে, ‘সব প্রশংসা তাঁর; যিনি আমাদের মৃত্যু দেওয়ার পর আবার জীবিত করেছেন। তাঁরই কাছে একত্রিত হতে হবে।’ মোমিন আল্লাহর সঙ্গ অনুভব করে তাঁর ইবাদতে, লেনদেনে, উপার্জনে, খরচে। আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করে কোলাহলে, নির্জনে; এমনকি বিপদে ও প্রিয়জনের বিয়োগেও।
নবী-পুত্র ইবরাহিমের ইন্তেকাল হলে, তার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। তিনি বললেন, ‘হে ইবরাহিম, আল্লাহর শপথ! আমরা তোমার বিয়োগ-ব্যথায় ব্যথিত।’ (বোখারি ও মুসলিম)। তাবাকাতুল হানাবিলার পরিশিষ্টে এসেছে, ইমাম ইবনে আকিল হাম্বলির পুত্র ইন্তেকাল করল। তিনি তার বিদায়ে বেদনাহত হলেন। জানাজা শেষ হলো। তিনি এলেন তার কাছে। কাফনে মোড়ানো সে। শুধু মুখটা খোলা। ইবনে আকিল ছেলের দিকে ঝুঁকে তাকে চুমু খেলেন। বললেন, ‘হে আমার পুত্র! আমি তোমাকে সেই সত্তার কাছে সমর্পণ করছি, যিনি আমানত নষ্ট করেন না। পিতার চেয়ে রবই তোমার জন্য কল্যাণকর হবে।’ দারিদ্র্যে-সচ্ছলতায়, সুখে-দুঃখে মোমিন আল্লাহর নৈকট্য বুকে ধারণ করেই জীবনযাপন করে। তার ইহ-পরকাল, জীবন-মৃত্যু সব আল্লাহর জন্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ সব বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরিক নেই। আমি এতেই আদিষ্ট হয়েছি। আমিই সর্বপ্রথম আত্মসমর্পণকারী।’ (সুরা আনআম : ১৬২)।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুইনুল ইসলাম