ঢাকা শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ৪ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কোরআন-হাদিসের ভাষা

গোলাম রাজ্জাক কাসেমী
কোরআন-হাদিসের ভাষা

ভাষা নিছক কিছু শব্দমালা নয়; বরং মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তা-চেতনার ধারক; শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির বাহক। আমাদের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস-সংস্কৃতি মিলে ভাষা ধারণ করে নতুন পরিচয়, নতুন মাত্রা। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও জীবন্ত ভাষাসমূহের মধ্যে অন্যতম আরবি ভাষা। এটি সেই মহিমান্বিত ভাষা, যাকে আল্লাহতায়ালা নিজেই অন্যান্য ভাষার ওপর বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর ওপর এ ভাষায় নাজিল করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি কোরআন নাজিল করেছি আরবি ভাষায়, যেন তোমরা বুঝতে পার।’ (সুরা ইউসুফ : ২)। এ কারণে আরবি কোনো নির্দিষ্ট জাতি, জনগোষ্ঠী বা নির্ধারিত ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং তা ইসলাম ও সমগ্র মুসলমানের ভাষায় পরিণত হয়েছে।

অনন্যতায় আরবি ভাষা : আজ পর্যন্ত পৃথিবীর চর্চিত ভাষার সংখ্যা সাত হাজার। এর মধ্যে মাত্র ২৩টি ভাষাতেই কথা বলে পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ। বিলুপ্তির পথে আছে পৃথিবীর প্রায় চার হাজার ভাষা। ভাষাবিদরা মনে করেন, প্রতি ১৪ দিনে একটি ভাষা পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। কালের আবর্তে পৃথিবীর সব ভাষাতেই ব্যাপক পরিবর্তন হলেও আরবি এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। কারণ, কোরআন-হাদিস আরবি ভাষার মূল উৎস। কেয়ামত পর্যন্ত তা টিকিয়ে রাখার রক্ষাকবচ। এ ভাষা সূচনা থেকেই সর্বাধুনিক ও সমৃদ্ধ। বর্তমানে আরবি ভাষা সর্বাধিক প্রচলিত ও জীবন্ত ভাষাসমূহের একটি। গোটা পৃথিবীর ২৮টি দেশের রাষ্ট্রভাষা আরবি। প্রতিদিন প্রায় ৫৫০ মিলিয়নের অধিক মানুষ এ ভাষায় কথা বলে। প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষের মাতৃভাষা আরবি। পঁচিশ কোটি মানুষের দ্বিতীয় ভাষা আরবি। ফলে ভাষাভাষীর সংখ্যা বিবেচনায় চীনা, ইংরেজি ও স্প্যানিশের পর আরবি বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। এটি জাতিসংঘের স্বীকৃত দাপ্তরিক ছয় ভাষার একটি।

মনীষীদের চোখে আরবি ভাষা : আরবি ভাষা পৃথিবীর সব ভাষার মধ্যে সবচেয়ে মধুর ও সুন্দর, সর্বাধিক সমৃদ্ধ ও মহিমান্বিত। বিশেষত মুসলমানদের জন্য আরবি ভাষা এক অনন্য সেতু, যা পেরোলেই কোরআনের সৌন্দর্যে, হাদিসের গভীরে এবং ইলমে দ্বীনের বারিধারায় সফলভাবে পৌঁছা যায়। তাছাড়া আরবি ভাষা পবিত্র কোরআনের ভাষা, প্রিয় নবী (সা.)-এর ভাষা, জান্নাতের ভাষা, ফেরেশতাদের ভাষা এবং সর্বোপরি আমাদের দ্বীনের ভাষা; যা জানা না হলে দ্বীনই অজানা থেকে যায়। তাইতো ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেছেন, ‘তোমরা আরবি ভাষা শেখ। কেননা, আরবি ভাষা তোমাদের দ্বীনের অংশ।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় আরবি ভাষা দ্বীনের অংশ। এটি জানা ফরজ। কারণ, কোরআন-হাদিস বোঝা ফরজ। যা আরবি ছাড়া সম্ভব নয়। আর যা ছাড়া ওয়াজিব পালন করা যায় না, সেটিও ওয়াজিব।’ আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘আরবি ভাষা দ্বীনের অংশ। কেননা, তা ফরজ। এর মাধ্যমেই কোরআন-হাদিসের মর্ম জানা যায়।’ ইমাম শাতেবি (রহ.) বলেছেন, ‘একজন ইসলামি আইনবিদের স্তর বৃদ্ধি পায় তার আরবি জানার স্তর অনুযায়ী।’ অনুরূপভাবে ইমাম ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘হাদিসের ছাত্রের জন্য আরবি ভাষায় গভীর জ্ঞান রাখা আবশ্যক।’

আরবি ভাষা শেখার গুরুত্ব : আরবি ভাষার এ পথটি অনেক দীর্ঘ। এর শাখাপ্রশাখা ব্যাপক বিস্তৃত। এর ব্যাকরণ যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং শব্দভাণ্ডারও বিপুল। তাইতো ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ইসলামি আইনশাস্ত্র ভালোভাবে আয়ত্ত করার জন্য ২০ বছর আরবি ভাষা শিখেছেন। এরপর তিনি আরবি ভাষা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আরবের ভাষা সর্বাধিক বিস্তৃত ভাষা। এর রয়েছে অনেক শব্দ। নবী ছাড়া কেউ এর সব জ্ঞানার্জন করতে পারবে বলে জানা নেই। আরবি ভাষায় দক্ষ লোকেরা জিনের মতো। তারা এমন কিছু দেখতে পায়, যা অন্যরা দেখে না।’ তাই দ্বীনের গভীর জ্ঞানার্জনে আরবি ভাষা শেখার জন্য আমাদের কী পরিমাণ চেষ্টা ও সাধনা করা প্রয়োজন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং আরবি ভাষাপ্রেমী ও ইলমে দ্বীনের অভিযাত্রীদের আরবি শেখায় নিবিড়ভাবে আত্মনিয়োগ করা উচিত। আরবি শেখা মানে কেবল একটি ভাষা শেখা নয়, বরং দ্বীনের গভীরে এগিয়ে যাওয়ার অভিযাত্রা।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, আরবি ভাষা বিভাগ, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা, ঢাকা

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত