রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালের সামনে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) নৃশংসভাবে হত্যার নেপথ্যে ছিল পল্লী বিদ্যুতের চোরাই তার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব। হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা ও খুন হওয়া লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ ছিলেন পূর্বপরিচিত। পরবর্তী সময় স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জেরেই এই খুনের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত লাল চাঁদের ওপর পাথর নিক্ষেপকারী দুই ব্যক্তিসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়। লাল চাঁদ হত্যা মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে ডিএমপির কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী এই সংবাদ সম্মেলন ডেকেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, ঘটনা চলাকালে জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে খবর পেয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মবের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছেন। ‘চাঁদাবাজদের জায়গা নাই, ব্যবসায়ীদের ভয় নাই’ এমন স্লোগান দিচ্ছিলেন তারা। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল থেকে মহিন ও পাশের এলাকা থেকে রবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাথর নিক্ষেপকারী দুজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই ঘটনায় মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ সাজ্জাত আলী বলেন, দেশের যে কোনো নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচয় থাকতেই পারে। সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এ ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মামলার এজাহার নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সাজ্জাত আলী। তিনি বলেন, এজাহার নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হলো, মামলার এজাহারের জন্য প্রথমে লাল চাঁদের সাবেক স্ত্রী লাকি আক্তার থানায় আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তার সৎভাইও থানায় আসেন। তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে ২৩ জনকে আসামি করে একটি খসড়া এজাহার প্রস্তুত করেন। একই সময়ে লাল চাঁদের বড় বোন মঞ্জুয়ারা বেগম থানায় এসে এজাহার দাখিলের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন মঞ্জুয়ারার সামনে আগের খসড়া উপস্থাপন করা হয়। সে সময় তার মেয়ে খসড়া এজাহারের ছবি তুলে রাখেন, যা পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মঞ্জুয়ারাই বাদী হয়ে মামলাটি করেন। ডিএমপি কমিশনার বলেন, মঞ্জুয়ারা খসড়া এজাহার থেকে পাঁচজনের নাম বাদ দিয়ে নতুন একজনের নাম সংযোজন করে মোট ১৯ জনকে আসামি করেন। তার লিখিত এজাহারের ভিত্তিতে কোতোয়ালি থানায় মামলা করা হয়। এজাহার একটি প্রাথমিক তথ্যবিবরণী মাত্র। এজাহারে উল্লেখিত ঘটনা তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চান, এই নারকীয় ঘটনায় জড়িত সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি এ ধরনের অপরাধের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
হত্যার নেপথ্যের কারণ নিয়ে করা এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এসএন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে এই হত্যাকাণ্ড হয়নি। লাল চাঁদ আগের সরকারের সময়ে পল্লী বিদ্যুতের চোরাই তারের ব্যবসা করতেন। পটপরিবর্তনের পর আরেকটা গ্রুপ এই ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হয়। দুই দলই আগে থেকে পরস্পরকে চিনত।
৯ জুলাই মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে লাল চাঁদকে হত্যা করে একদল লোক। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাকে পিটিয়ে, ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করা হয়। তার শরীরের ওপর উঠে লাফান কেউ কেউ। লাল চাঁদ হত্যার ঘটনায় রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় ১০ জুলাই মামলা হয়। নিহত লাল চাঁদের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ১৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে।