
গণশুনানি উপেক্ষা করে কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে তড়িঘড়ি করে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) রচনা করা হয়েছে। ফলে ভবন নির্মাণের অনুমোদনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও জনভোগান্তি বেড়েছে। ভবন নির্মাণ শিল্পে স্থবিরতা তৈরি হওয়ায় ‘বৈষম্যমূলক’ ড্যাপ সংশোধনের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট। গতকাল রোববার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি করা হয়। ‘জনবৈরী ড্যাপ, বৈষম্যপূর্ণ পরিকল্পনা : নিম্ন নাগরিক বাসযোগ্যতা ও বিপন্ন পরিবেশ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে ড্যাপের ১২টি আইনগত ও তথ্যগত ত্রুটি তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উত্থাপন করেন বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ড. মাসুদ উর রশিদ। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সভাপতি স্থপতি ড. আবু সাঈদ এম আহমেদ, সহ-সভাপতি (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক) স্থপতি খান মোহাম্মদ মাহফুজুল হক, সহ-সভাপতি (জাতীয় বিষয়াদি) স্থপতি নওয়াজীশ মাহবুব, সম্পাদক (পেশা) স্থপতি ওয়াহিদ আসিফ, সম্পাদক (ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি) স্থপতি কাজী শামীমা শারমিন প্রমুখ।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ বলেন, ‘ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এখনই দরকার ড্যাপ বাতিল করা। বর্তমান ড্যাপে অনেক ডেটা ভুল আছে। সেগুলো সংশোধন করে নতুন ড্যাপ তৈরি করতে হবে।’ এরইমধ্যে স্থপতি ইনস্টিটিউট সরকারের কাছে নতুন ড্যাপ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকা নিয়ে ত্রিমাত্রিক সার্ভে করার কথা আমরা বলেছি এবং ডেটা আপডেট করে নতুন ড্যাপ বানাতে হবে।’
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ বলেন, ‘ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এখনই দরকার ড্যাপ বাতিল করা। বর্তমান ড্যাপে অনেক ডেটা ভুল আছে। সেগুলো সংশোধন করে নতুন ড্যাপ তৈরি করতে হবে।’
এরইমধ্যে স্থপতি ইনস্টিটিউট সরকারের কাছে নতুন ড্যাপ তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঢাকা নিয়ে ত্রিমাত্রিক সার্ভে করার কথা আমরা বলেছি এবং ডেটা আপডেট করে নতুন ড্যাপ বানাতে হবে।’
সংগঠনটি বলেছে, ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এখনই ড্যাপ সংশোধন করা দরকার। কারণ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক প্রণীত ড্যাপ রাজধানী ঢাকার নাগরিক বাসযোগ্যতা ও পরিবেশ বিপন্ন করে তুলেছে। এর প্রমাণ, ড্যাপ প্রণয়নের পরে গত চার বছরে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ১৩৮ থেকে ১৭১তম স্থানে নেমে এসেছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপনে স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি আবু সাঈদ এম আহমেদ লিখিত বক্তব্যে বলেন, আইনি ব্যত্যয়, প্রকাশিত তথ্যের অপর্যাপ্ততা, প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, পরিবেশ বিপর্যয় (কৃষিজমি বিনষ্ট ও প্রাকৃতিক জলাধার ভরাট), ভবন নির্মাণের অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি বৃদ্ধি, বৈষম্যমূলক নীতির প্রয়োগ, জনভোগান্তি বৃদ্ধিসহ অসংখ্য অসংগতিনির্ভর এই ড্যাপ (২০২২-৩৫) বর্তমানে ভবন নির্মাণশিল্পে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে।
সংগঠনটির নেতারা বলেন, ড্যাপ ২০২২-২০৩৫ গেজেটেড হওয়ার আগপর্যন্ত ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ সম্পূর্ণরূপে কার্যকর ছিল। সেই নিয়মে ঢাকা শহরের সব স্থানে রাস্তার প্রশস্ততার ওপর ভিত্তি করে একই পরিমাণ ক্ষেত্রফলের ভবন নির্মাণ করা যেত। ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর থেকে নাগরিক সুবিধার ওপর ভিত্তি করে ঢাকা শহরের ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকাকে আরও অভিজাত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অপর দিকে রায়েরবাজার, বাড্ডা, পুরান ঢাকার মতো এলাকাকে মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
স্থপতি ইনস্টিটিউটের নেতারা বলেন, আইন হবে এমন, যা জনগণ মানতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু ড্যাপ এমন আইন, যা জনগণ ব্যত্যয় করতে বাধ্য হচ্ছে। রাজউক তদারকি করতে পারে না, এর প্রমাণ হলো বছিলা। মানুষের প্রয়োজন আবাসস্থল। আইন কঠিন হলে জনগণ আইনের তোয়াক্কা না করে ভবন নির্মাণ করবে। ধনীদের জন্য বেশি সুযোগ, আর গরিবের জন্য কঠিনতর আইন, মধ্যবিত্তের কোনো জায়গা থাকবে না। এভাবে জনবৈরী আইন প্রয়োগ করা হয়েছে ড্যাপে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা সারা বাংলাদেশের সমস্যা। শুধু ঢাকা শহরকে বাঁচাতে গিয়ে জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের নামে এলাকাভেদে জনঘনত্ব নির্দিষ্ট করা হয়েছে। যেমন ড্যাপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে পুরান ঢাকার জনঘনত্ব ৪৫০ ছিল। কিন্তু ড্যাপ ২০২২-৩৫ প্রস্তাবনায় ২০২৫ সালে এই জনঘনত্ব ৩৬৭ জনের কথা বলা হয়েছে। তাহলে ২০২৫ সালে এসে ৮৩ জন কোথায় যাবে? ঢাকার জনগণ কি রোহিঙ্গাদের মতো বাস্তুহারা হবে।
স্থপতি ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে কয়েকটি দাবি তুলে ধরা হয়, বর্তমান স্ট্রাকচার প্ল্যান ও তিন ধাপভিত্তিক মহাপরিকল্পনার সর্বশেষ তৃতীয় ধাপের গেজেটকৃত ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) বাতিল করতে হবে। রাজউক ও গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (জিডিএ) আইনের সঠিক ও যৌক্তিক বাস্তবায়নের জন্য ডিজিটাল ও সহজলভ্য ভূমি ব্যবহার মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। প্রাকৃতিক, মানবসৃষ্টসহ সব দুর্যোগের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দুর্যোগসহনীয় একটি অংশগ্রহণমূলক ও হালনাগাদ মৌজাভিত্তিক ড্যাপ তৈরি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তা পর্যালোচনা ও পরিচালনা করা। বৃহত্তর ঢাকা মহানগরীসহ পাশের গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এলাকা নিয়ে অবিলম্বে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট সব দুর্যোগ সহনশীলতা বিবেচনায় নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক, পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব ও বৈষম্যহীন আধুনিক-আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন তিন ধাপভিত্তিক (স্ট্রাকচার প্ল্যান, আরবান এরিয়া প্ল্যান ও ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান) ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এই পরিকল্পনায় সরকারের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), শূন্য নির্গমনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির যথাযথ সংযোজন নিশ্চিত করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্থপতি ইনস্টিটিউটের নেতারা বহুদিন ধরে রাজউকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিফলন পাননি। তাই জনগণের দাবি ও অধিকার তুলে ধরতে আজ সংবাদ সম্মেলন করছেন। জনদুর্ভোগ এড়াতে, ভবিষ্যতের ঢাকা বাঁচাতে, বাসযোগ্য নগর গড়তে ও নির্মাণশিল্পের সঙ্গে যুক্ত লাখো মানুষের স্বার্থ রক্ষায় তাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আমরা বহুদিন ধরে রাজউকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো প্রতিফলন পাইনি। তাই আজ জনগণের দাবি ও অধিকার তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। জনদুর্ভোগ এড়াতে, ভবিষ্যতের ঢাকা বাঁচাতে, বাসযোগ্য নগর গড়তে এবং নির্মাণ শিল্পের সাথে যুক্ত লক্ষ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। আমরা বিশ্বাস করি, সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ জনগণই পারে টেকসই, ন্যায্য ও সমৃদ্ধ ঢাকা গড়ে তুলতে।
আইনি ব্যত্যয় : ড্যাপের প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা আছে ঢাকার কৌশলগত পরিকল্পনা তিনস্তরে হবে। প্রথমটি স্ট্রাকচার প্ল্যান, দ্বিতীয়টি ঢাকা আরবান এরিয়া প্ল্যান এবং তৃতীয়টি ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান বা ড্যাপ। এই তিনটি স্তরের মধ্যে শুধু ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। বাকি দুটি স্তরের অস্তিত্ব নেই। বরং স্ট্রাকচার প্ল্যান পরিবর্তে ড্যাপে ইমারত নির্মাণ বিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যার কারণে যত জটিলতা শুরু হয় এবং নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
জলাধার আইন ভঙ্গ : দেশের জলাধার আইনে বলা হয়েছে শুকনো মৌসুমে নদী যতখানি প্রশস্ত তা জলাভূমি আর বর্ষা মৌসুমে নদী যতখানি প্রশস্ত তা প্লাবনভূমি। ড্যাপে সুযাগ দেওয়া হয়েছে প্লাবন ভূমিতে ভবন নির্মাণের। এতে বর্ষা মৌসুমে শহরের পানি বের হতে পারবে না, ফলে জলাবদ্ধতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
কৃষিজমি ভরাট : ড্যাপ (২০২২-৩৫) এ কৃষিজমিতে রাজউকের অনুমোদনক্রমে অস্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যার ফলে অচিরেই অনেক কৃষিজমি হারিয়ে যাবে। কৃষিজমি কমে গেলে ভবিষ্যতে খাদ্যসংকট বাড়তে পারে। শহরের আশপাশে কৃষিজমিগুলো শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহৃত হয়ে না, এগুলো শহরের ফুসফুসের মতো কাজ করে।
পথচারী বিরূপ ফুটপাত : মানুষের চলাচলের জায়গা ফুটপাত, আর সেই ফুটপাতে নির্ধারিত ফি দিয়ে দোকান করার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এতে ফুটপাত দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারবেন না।
সড়কে যানজট বৃদ্ধি : ড্যাপে ভবনে পার্কিংয়ের সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যার ফলে শহরের সড়কের ওপর অবৈধ পার্কিংয়ের প্রবণতা বাড়বে এবং দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হবে।
দুর্যোগ সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা : দুর্যোগ সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনার জন্য ‘আরবান ডিজাইন ও ব্যবস্থাপনা’ পদ্ধতি সংযুক্তপূর্বক নতুন ড্যাপ পরিশীলিত ও জনবান্ধব করে পুনঃপ্রস্তুত করতে হবে। কারণ গত দুই দশক ধরে অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনার ফসল স্বরূপ এই নগরীর ক্রমাগত বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে- বসুন্ধরা সিটি ফায়ার, নিমতলী অগ্নিকাণ্ড, তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড, এফআর টাওয়ারে আগুন, চুড়িহাট্টা রাসায়নিক গুদাম অগ্নিকাণ্ড, কেরানীগঞ্জ প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, তল্লা মসজিদ গ্যাস লিকেজ, হাশেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে অগ্নিকাণ্ড এবং সর্বশেষ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সামরিক বিমান দুর্ঘটনা। এছাড়াও প্রতিনিয়ত সিলিন্ডার বিস্ফোরেণের ঘটনা ঘটছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে মাটির গভীরে পুঞ্জিভুত শক্তি বিশাল ভূমিকম্প হয়ে আঘাত হানলে ৪৫০ বছরের আবর্তিত চক্রে সমগ্র ঢাকা পরিণত হবে একটি অগ্নিকুণ্ডে। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রস্তুত করা ঢাকা মহানগরীর দুর্যোগের তথ্যউপাত্ত এবং মাইক্রোজোনেশন ম্যাপকে একীভূত করে একটি কার্যকরী দুর্যোগ সংবেদনশীল ড্যাপ তৈরি করা প্রয়োজন।