ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

সোনাগাজীর মুহুরী প্রজেক্টে পর্যটনের হাতছানি

সোনাগাজীর মুহুরী প্রজেক্টে পর্যটনের হাতছানি

ফেনীর সোনাগাজীর মুহুরী প্রজেক্ট পর্যটনশিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় স্থান। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯৭৭-৭৮ অর্থ বছরে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ১৯৮৫-৮৬ অর্থ বছরে এই সেচ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ফেনী নদী, মুহুরী নদী এবং কালিদাস পাহালিয়া নদীর সম্মিলিত প্রবাহকে আড়ি বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ৪০ ফোক্ট (দরজা) বিশিষ্ট একটি বৃহদাকার পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করা হয়। ফেনী জেলার ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, ফুলগাজী, সোনাগাজী এবং চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই উপজেলার বৃহদাংশ এলাকায় বর্ষা মৌসুমে বন্যার প্রকোপ কমানো ও আমন ফসলে অতিরিক্ত সেচ সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল মুহুরী সেচ প্রকল্প। সিডা, ইইসি, বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তায় জাপানের সিমুজু কোম্পানী এই সেচ প্রকল্প নির্মাণ করে। এর ফলে ২০ হাজার ১৯৪ হেক্টর এলাকায় সেচ সুবিধা এবং ২৭ হাজার ১২৫ হেক্টর এলাকা সম্পূরক সেচ সুবিধার আওতায় আসে। সংরক্ষণ করা যায় উজানের মিঠা ও জোয়ারের নোনা পানি। মুহুরী সেচ প্রকল্পকে ঘিরে গত তিন দশকে গড়ে ওঠে বিনোদন ও পিকনিক স্পট। শীত, গ্রীষ্মসহ প্রায় প্রতিটি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলে দলে ভ্রমণপিয়াসু লোক এবং পর্যটক বেড়াতে আসে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মুহুরী রেগুলেটরের চারদিকে বাঁধ দিয়ে ঘেরা কৃত্রিম জলরাশি, বনায়ন, মাছের অভয়ারণ্য, পাখির কলকাকলি, বাঁধের দুপাশে নীচ থেকে পাথর দিয়ে বাঁধানো এবং উপরদিকে দুর্বা ঘাসের পরিপাটি বিছানা। মুহুরীর জলরাশিতে নৌভ্রমণের সময় খুব কাছ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস এবং প্রায় ৫০ জাতের হাজার হাজার পাখির দেখা পাওয়া যায়।

এছাড়া রয়েছে নদীর পাড়ে সবুজ বনানী ঘেরা মায়াবী পরিবেশ। এক সময় শীতকালে অতিথি পাখির আগমন ঘটত। এখন প্রতিটি মৌসুমে অতিথি পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলিতে মুখরিত থাকে পুরো এলাকা। কারণ এক সময় বিকট শব্দে বন্দুক দিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে পাখি নিধন করা হত, এখন বন্দুকধারী সেই পাখি শিকারিদের আনাঘোনা কমে যাওয়ায় অতিথি পাখিগুলো মায়াবী পরিবেশ ছেড়ে ফেরত যায় না। গত দুই-তিন বছর থেকে প্রতিটি মৌসুমে অতিথি পাখির কলরব ও দেশি-বিদেশি পর্যটকদের পদভারে সরগরম থাকে এলাকাটি। প্রকৃতির টানে যে আসে তাকেই মুগ্ধ করে এখানকার প্রকৃতি।

নদীর পানিতে সুর্যোদয় ও সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। পূর্ণিমার চাঁদ বিলাস দেখতে রাতের বেলায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে পর্যটকের দল। চাঁদনী রাতের শোঁ-শোঁ করা বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে। এই সেচ প্রকল্প এলাকায় চারপাশে রয়েছে সবুজের সমারোহ। নদীতে নৌকার সারি, মাছ ধরা ও নৌকাভ্রমণের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ৬ একর জমিতে প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ভারতের নেভুলা কোম্পানীর মাধ্যমে মুহুরী রেগুলেটরের ৫০০ গজ দূরে নির্মাণ করা হয় দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র। সেখান থেকে উৎপাদিত প্রায় ০.৯ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে ব্যবহৃত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এ এলাকায় প্রায় ১ হাজার একর এলাকাজুড়ে চিত্তাকর্ষক নৈসর্গিক শোভা ও মনোমুগ্ধকর অসংখ্য দৃশ্য বিদ্যমান। এর ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’ নামে নির্মিত হচ্ছে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এরইমধ্যে সোনাগাজী-মীরসরাই উপজেলায় প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি স্থাপনা ও সড়ক-মহাসড়ক। বর্তমানে মৎস্য চাষে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় মৎস্য জোন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে এ মুহুরী প্রকল্প এলাকা।

এই এলাকায় পুকুর খনন করে হাজার হাজার মৎস্যচাষি তাদের জীবিকানির্বাহ করছে। উৎপাদিত অর্থ জাতীয় অর্থনীতিতে জোগান দিচ্ছে। সিডিএসপি বেড়িবাঁধ, ছোট স্লুইস গেট বেড়িবাঁধ এবং মীরসরাই-জোরারগঞ্জ বেড়িবাঁধের উপর দিয়ে প্রতিদিন মাছ বহনকারী হাজার হাজার গাড়ি চলাচলের কারণে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে কয়েকটি বেড়িবাঁধ। ফলে পর্যটক, মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। প্রতিদিন উল্লেখিত সড়কগুলোতে ঘটছে নানা দুর্ঘটনা। নষ্ট হচ্ছে ট্রাক পিকআপসহ বিভিন্ন যানবাহন।

মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদার করতে স্থাপন করা হয়েছে- একটি পুলিশ ফাঁড়ি। মুহুরী নদীতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভাসমান মাচ চাষ, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য, দেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, পরিকল্পিত মাছ চাষ, ডেইরি ফার্ম, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নার্সারি ও অ্যাগ্রো খামার ইত্যাদির দৃশ্য চোখ জুড়িয়ে দেয়। জীবন-জীবিকার তাগিদে খেটে খাওয়া মানুষের হরেক রকম জীবনকর্মের দৃশ্যও দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষের থেকে একটু ভিন্ন। নদীতে জাল ফেলে নোনা পানিতে ভেসে চিংড়ি পোনা সংগ্রহের দৃশ্যে সবার নজর কাড়ে। প্রকৃতি আর মানুষের ভালোবাসা, আতিথেয়তা যেকোনো পর্যটকের মনে থাকবে বহুকাল। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর পর্যটনকেন্দ্র বা নগরী হিসেবে গড়ে ওঠার কথা থাকলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের সদিচ্ছার অভাবে এ অঞ্চলে কাঙ্ক্ষিত পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেনি। গড়ে উঠেনি হোটেল-মোটেল ও পর্যটকদের চাহিদা পূরণ করার মতো দোকানপাট, মার্কেট।

প্রকৃতির টানে ছুটে আসা পর্যটকদের হৃদয় কাড়লেও থাকাণ্ডখাওয়ার সুব্যবস্থার অভাবে অনেককে নিরাশ হতে হন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আধুনিক একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠলে এ থেকে সরকারের কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতো বলে দাবি করেন স্থানীয়রা। মানসম্মত থাকা খাওয়ার হোটেলের পাশাপাশি পরিবহনের সংখ্যা ও মানবৃদ্ধি, পর্যটন কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, এলাকা ও স্থাপনাগুলো মনোরমভাবে সাজানো ও রক্ষণাবেক্ষণ, সোনাগাজী ও চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে মানুষের যাতায়াত সহজ করা ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ সোনাগাজীর এ পর্যটনশিল্পকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। আর পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারলে এখানে অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

অপার সম্ভাবনাময় এই সেচ প্রকল্পের উপকণ্ঠে অবৈধভাবে ও অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র যার ফলে পুরো মুহুরী সেচ প্রকল্প চরম হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। তাই এটি পর্যটনশিল্পের আওতায় সঠিক তদারকিতে অবৈধ ও অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনও বন্ধ হত বলে মনে করেন স্থানীয়রা। ফেনী-৩ (সোনাগাজী-দাগনভূঞা) আসনের সাবেক এমপি লে. জে (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী সংসদ সদস্য থাকাকলীন সরকারিভাবে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই সরকরিভাবে অবকাঠিমো তৈরি করে পর্যটনকেন্দ্র করা হোক।

সোনাগাজী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন বাবলু বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন প্রকল্প এলাকায় শত শত লোক ও প্রতিষ্ঠান মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে আসে।

অপার সম্ভাবনাময় এলাকাটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ার পাশাপাশি এলাকার বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতো।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত