ঢাকা মঙ্গলবার, ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাংলাদেশের

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ২০ শতাংশ নামিয়ে নিয়ে আসায় তৈরি পোশাক খাতে সফলতার সম্ভাবনা দেখছেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। এরইমধ্যে প্রতিযোগী অন্যদেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন। ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একইসঙ্গে বাংলাদেশের বৃহৎ দুটি বাণিজ্যিক অংশীদার চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কী প্রতিক্রিয়া দেখায় সেটির ওপরও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও কিভাবে ভালো করা যায় সেব্যাপারে সামনের দিনগুলোতে কাজ করা হবে। কিছু বিষয়ে দুপক্ষ একমতে পৌঁছা সম্ভব হয়নি, যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা অব্যহত থাকবে। বর্তমান শুল্ক নির্ধারণকে চূড়ান্ত ফলাফল মনে করে আত্মসন্তষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই এবং সেটি করলে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি দেখা হবে বলে তিনি জানান।

তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, মার্কিন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির বড় সুযোগ তৈরি হবে। এর কারণ চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক থাকায় সেখান থেকে প্রচুর কার্যাদেশ সরবে। তার একটা অংশ পেতে পারে বাংলাদেশ। ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক থাকায় সেটি বড় আকারেও হতে পারে। তারা আরও বলেন, মার্কিন বাজারে উচ্চ শুল্কের কারণে চীনারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে আগ্রাসী হতে পারে। তাতে বাজারটিতে বাংলাদেশ নতুন করে প্রতিযোগিতায় পড়বে।

জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক শীর্ষ বড় বাজার। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৬ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। রপ্তানি হয়েছে ৭৫৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন শীর্ষস্থান দখল করে আছে। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে জড়ায়। এরপর চীন থেকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। চলতি বছর ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর চীন থেকে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর ত্বরান্বিত হয়। মাঝে পাল্টা শুল্কের কারণে মার্কিন ক্রেতা ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পর্যবেক্ষণের জন্য ধীরে চলো নীতি নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ ১০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ভিয়েতনাম, চীন, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও কোরিয়া। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভিয়েতনামের পণ্যে ২০ শতাংশ, চীনা পণ্যে ৩০, বাংলাদেশের পণ্যে ২০, ভারতের পণ্যে ২৫, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের পণ্যে ১৯ এবং কোরিয়ার পণ্যে ১৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।

কী কী বিষয়ে ঐকমত্য : যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ সরকার গম, সয়াবিন ও জ্বালানি আমদানি করবে। এছাড়া মার্কিন কোম্পানি বোয়িং থেকে উড়োজাহাজও কেনার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি খাতকে আরও বেশি আমদানির জন্য উৎসাহিত করার বিষয়ে একমত হয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে চীন থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় কমানো বা মার্কিন মোটরগাড়ির ওপর শুল্ক কমানোর বিষয়ে রাজি হয়নি বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয়েছে, সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় নির্ভর করে চাহিদা, দাম ও ক্রয় শর্তের ওপর। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বাংলাদেশের এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। অন্যদিকে মোটরগাড়ির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক সুবিধা দিলে, সেটি জাপানকেও দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন গাড়ি বাজারজাতকরণ বিশেষ সুবিধা পাবে না। মাঝখান থেকে বাংলাদেশ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। বাংলাদেশে মেধাস্বত্ব অধিকার লঙ্ঘেনের কারণে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হয় অনেক মার্কিন কোম্পানি। এটি কমিয়ে আনার জন্য মেধাস্বত্ব বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও কনভেনশনগুলোয় বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় অন্তর্বর্তী সতর্ক অবস্থান নেয়। মার্কিন পক্ষকে জানানো হয়, এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও কনভেনশনে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে অন্যগুলোতে বাংলাদেশ অংশীদার হবে, তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সময় লাগবে।

এদিকে, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেস মিটের মাধ্যমে জানতে পেরেছি- বাংলাদেশের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এটার সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করবে আমাদের বাণিজ্যিক সক্ষমতার ওপরে। এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাণিজ্য উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।

শুল্ক আলোচনায় সমঝোতা করতে গিয়ে বাংলাদেশ একটি গোপনীয়তার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের স্বার্থ পরিপন্থি’ কোনো কাজ করছে কি না এ ব্যাপারে তিনি বলেন, গোপনীয়তার চুক্তি আন্তর্জাতিক দিক দিয়েও নির্দিষ্ট। এমনকি স্থানীয়ভাবে দুটি ব্যবসায়িক সংগঠন বা ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠান যখন কোনো চুক্তিতে উপনীত হয় সেখানেও এনডিএ (নন ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট) খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। দুজন যদি কোনো সম্পদ হস্তান্তরও করে তখন নিজেদের মধ্যে এক ধরনের আলোচনা থাকে এর গোপনীয়তা রক্ষার।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তি সম্পন্ন না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি করা হয়ে থাকে। কেননা, তার মনে হতে পারে- আমার প্রতিবেশী এই চুক্তিতে সমস্যা করতে পারে বা অন্য কেউ এসে এখানে দাবি করতে পারে। মূলত যুক্তরাষ্ট্র যে বিনিময় চুক্তিটি করছে সেখানে তারা তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে ব্যবহার করেছে। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তাদের চুক্তির মূল নিয়ামক হিসেবে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তাকে বেছে নিয়েছে সেখানে আলোচনার গোপনীয়তার শর্ত থাকা অবশ্যম্ভাবী। এর মাধ্যমে দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করার কোনো উপাদান থাকলে আমরা সে চুক্তিতে উপনীত হবো না। কারণ, আমরা দেশের স্বার্থে স্বার্থবান। আমাদের নিজস্ব স্বার্থ বিসর্জন দেওয়ার তো কোনো সুযোগই নেই। নিজস্ব স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলে আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি ঘটবে। তাতে আমাদের বাণিজ্য চুক্তি করেও কোনো লাভ হবে না। স্বল্পমেয়াদে বা দীর্ঘ মেয়াদে যদি আমাদের বাণিজ্য সক্ষমতা যদি হ্রাস পায় কিংবা আমাদের ক্ষুদ্র অর্থনীতির কোনোরকম ক্ষতি হয় তবে সেই চুক্তি কোনোভাবেই পালনযোগ্য না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত