
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকে সরকার পতনের আন্দোলনে গিয়ে। যার পরপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালাতে বাধ্য হন। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়েছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের বহু দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফলতা পেয়েছে। প্রথমত, ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন যে আন্দোলন শুরু হয়, সেটি ছিল মূলত কোটা সংস্কারকেন্দ্রিক। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছেলে–মেয়ে, নাতি-নাতনিদের জন্য বরাদ্দকৃত কোটার পুনর্মূল্যায়ন ছিল মূল দাবি। কিন্তু আন্দোলন দমাতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের লাগামছাড়া বক্তব্য উসকে দেয় বিক্ষোভকে। ১৬ জুলাই প্রকাশ্যে গুলির আঘাতে শহীদ হন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া আবু সাঈদ। এরপর শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পথে নামে জনতাও। ফলে এই আন্দোলন ক্রমেই গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এই অভ্যুত্থান চলে প্রায় এক মাস। সরকারি হিসাবে, এখন পর্যন্ত শহীদ হয়েছেন ৮৪৪ জন। আহতের সংখ্যা ১৩ হাজারের বেশি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে চীনের হংকং আন্দোলনে ‘আমব্রেলা আন্দোলন’ সংঘটিত হয় ২০১৪ সালে। বিতর্কিত ‘বহিষ্কারবিরোধী আইন সংশোধন বিল’-এর প্রতিবাদে হয় ২০১৯ সালে। দুটি আন্দোলনের সম্মুখভাগেই ছিলেন ছাত্ররা। দেশটির গণতান্ত্রিক সংস্কার ও হংকংয়ের ওপর বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিরোধিতা করে এ দুটি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তনই ছিল প্রথম বিক্ষোভের মূল বিষয়। নিজেদের নেতা বাছাইয়ের সুযোগ চাইতেই রাস্তায় নামেন প্রতিবাদকারীরা। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে থেকে বাঁচতে সবাই ছাতা নিয়ে আসতেন। এ জন্যই এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আমব্রেলা আন্দোলন’। উভয় আন্দোলনই আন্তর্জাতিক মহলে দৃষ্টি কাড়ে। ফলে দেশটির চলমান সংকটে নজর পড়ে বিশ্ববাসীর। তৃতীয়ত, ২০১১ ও ২০১৩ সালে চিলির ছাত্র বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা খেয়াল করেন, ধনী শিক্ষার্থীরা লাতিন আমেরিকার সেরা কিছু স্কুলে পড়ার সুযোগ পান। অথচ দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ জরাজীর্ণ রাষ্ট্রীয় স্কুল। থাকে না পর্যাপ্ত তহবিল। তাই বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং বিনা মূল্যে মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। এটি দ্রুতই লাভ করে জনসমর্থন। লাখো শিক্ষার্থী-জনসাধারণ রাস্তায় নামেন। আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র ছিলেন ছাত্রনেত্রী কামিলা ভ্যালেজো। এই আন্দোলনের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সংস্কার করা হয়। বৃদ্ধি করা হয় শিক্ষার জন্য সরকারি তহবিল। প্রভাব পড়ে সামাজিক নীতিমালাতেও। চতুর্থ, ১৯৮৯ সালের চেকোস্লোভাকিয়া ভেলভেট বিপ্লবে বর্তমানে চেকোস্লোভাকিয়া নামে কোনো দেশ নেই। ১৯৯৩ সালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে গঠিত হয় দুটি দেশ। একটি চেক রিপাবলিক এবং অন্যটি স্লোভাকিয়া। দেশ ভাগের দুই বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে প্রতিবাদ শুরু করেন ছাত্ররা। বার্লিন ওয়াল পতনের ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়, কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। তারা দাবি করেন, রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। উল্টো ধীরে ধীরে যোগ দেয় বিভিন্ন বয়সের মানুষ। ২০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাগের রাস্তা ও ওয়েনসেচলাস স্কয়ারে জড়ো হয়। ভেলভেট বিপ্লব নামে পরিচিত এই আন্দোলনের কারণে দেশটির সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।