
জুলাই ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের পতিত আওয়ামী লীগের চিত্রায়ণে একপাক্ষিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এক দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন তিনি।
স্ট্যাটাসের শুরুতে তিনি সবিস্তারে লিখেছেন, ঘোষণার কোন অংশগুলো তার কাছে একপাক্ষিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হয়েছে। ঘোষণার শুরুতে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বয়ানটি নিয়ে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের আমলে ইতিহাসের রাজনীতি নিয়ে যে সমালোচনা ছিল, এই ঘোষণায় সেটা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ঘোষণার কিছু ভুলও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। যেমন, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধপরবর্তী দেশ গঠনের বিষয়টি পুরো উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের তৎকালীন শাসনামলকে কেবল একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
এছাড়া, যুদ্ধপরবর্তী দেশে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে ঘোষণায় দায় চাপানো হয়েছে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার দুর্বলতার ওপর। এখানে আপত্তি জানিয়ে বার্গম্যান বলেন, সে সময়ে আওয়ামী লীগ সন্দেহাতীতভাবেই অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন নিয়ে অভিযোগ কেবল নতুন সংবিধান প্রণয়নে আগ্রহীদের বয়ান জোরালো করতেই উত্থাপন করা হয়ে থাকতে পারে।
জুলাই ঘোষণায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উহ্য রাখার বিষয়টি নিয়েও আপত্তি জানান বার্গম্যান। তিনি বলেন, ঘোষণাটিতে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে হত্যার মতো ঘটনা পুরো অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ ওই হত্যাকাণ্ডের পরই দেশটি বহু বছরের জন্য সেনা শাসনের অধীনে চলে যায়।
১/১১-এর চক্রান্তে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে- ঘোষণার এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বার্গম্যান বলেছেন, কিছু স্থানে ভোট কারচুপির অভিযোগ থাকলেও, ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনকে ধরা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বচ্ছ নির্বাচন।
আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলকে ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী দাবি করার বিষয়ে বার্গম্যানের মন্তব্য, দলটি শুরুতে অগণতান্ত্রিক ছিল না, বরং দিনকে দিন তারা অগণতান্ত্রিক এবং স্বৈরাচারী সরকারে পরিণত হয়েছে।
ঘোষণাজুড়ে আওয়ামী শাসনামলকে জনবিরোধী, স্বৈরাচারী, মানবতাবিরোধী, দেশকে মাফিয়া ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণতকরণ, লুটপাটের মহোৎসব ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত করার বিষয়ে তিনি বলেছেন, অভিযোগগুলোর অবশ্যই সত্যতা রয়েছে। তবে এগুলো খুবই একপাক্ষিক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সাবেক ক্ষমতাসীন দলের এই কালো অধ্যায়ের পাশাপাশি আরেকটা অধ্যায় ছিল, যেমন ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নতি, নারী শিক্ষা, জলবায়ু নিয়ে সচেতনতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন, যা পুরো উপেক্ষা করা হয়েছে।
অবশ্য ঘোষণার কিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেছেন তিনি। বার্গম্যান বলেন, জুলাই ঘোষণায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যথাযথ সম্মান দেওয়ার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, গত বছরের আন্দোলনে আহত-নিহতের অতিরঞ্জিত সংখ্যার বদলে যুক্তিসংগত সংখ্যাটি উল্লেখ করা হয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়কেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন বার্গম্যান। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনের পর নিজের পরিণতির অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সম্মত হয়েছেন ড. ইউনূস। তবে পুরো ঘোষণাটি আরও সংক্ষিপ্ত হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন বার্গম্যান।