
শিক্ষার্থী নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের পর এক বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে যাওয়া অন্তর্বর্তী সরকার উন্নয়ন প্রকল্পে গুণগত ব্যয় নিশ্চিত করার পাশাপাশি তহবিল অপব্যবহার রোধে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে, যাতে প্রকৃত সুফল সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছায়।
ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) নির্বিচারে বড় অংকের বরাদ্দ দিয়ে তা অপচয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নের যে প্রবণতা ছিল যার পেছনে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতার ঘাটতিও ভূমিকা রেখে, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমান সরকার একটি নতুন কৌশল গ্রহণ করেছে। এই কৌশল অনুযায়ী, যে কোনো চলমান প্রকল্প যে কোনো সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারির আওতায় আসতে পারে, যাতে জনগণের ট্যাক্সের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করা যায়। এই ধারাবাহিকতায় সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের (চলতি অর্থবছর) এডিপিও আগামী ডিসেম্বর মাসে সংশোধন করার চিন্তা করছে। যদিও সাধারণত মার্চ মাসে এডিপি সংশোধন করা হয়ে থাকে, এটি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এটি বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে সংশোধিত বরাদ্দ যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় দিতে সহায়তা করবে। গত এক বছরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম এবং সংস্কার-সংক্রান্ত রোডম্যাপ নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এডিপির সংশোধিত সংস্করণ কমিয়ে আনা হয়েছিল, এবং নানা কারণে বাস্তবায়নের হারও কম ছিল। তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য তহবিলের অপব্যবহার রোধ, ব্যয়-কর্মদক্ষতা অর্জন এবং গুণগত ব্যয়ের দিকে অগ্রসর হওয়া, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর অনেক ঠিকাদার প্রকল্প থেকে পালিয়ে যাওয়ায় বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালককেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে চলতি অর্থবছরে সরকার মনে করে যে, এডিপির বাস্তবায়ন অনেক ভালো হবে, কারণ বাস্তবায়নযোগ্য একটি সাইজের এডিপি গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সম্ভবত আমরা মার্চের পরিবর্তে আগামী ডিসেম্বরেই এডিপি সংশোধন করার চেষ্টা করব, যাতে বাস্তবায়নের গতি বাড়ে। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, যদি মার্চে এডিপি সংশোধন করা হয়, তবে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অতিরিক্ত বরাদ্দ চায়, তারা সেই অর্থ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারে না, কারণ তখন অর্থবছরের মাত্র তিন মাস সময় থাকে।
তিনি আরও বলেন, আমরা এই প্রক্রিয়াটি দেশের জন্য প্রথমবারের মতো চালু করার চেষ্টা করছি, কারণ অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়ার পর যথাযথ সুফল পাওয়া যায় না, সময় কম থাকায়। যদি অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এডিপি সংশোধন করা যায়, তাহলে সংশোধিত বরাদ্দকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পূর্ণভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয় তিনি যোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের গত এক বছরে পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় কোনো গুণগত পরিবর্তন এসেছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য ড. মনজুর হোসেন বলেন, পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. মনজুর হোসেন বলেছেন, সরকার এখনও কাঠামোগত পরিবর্তন আনার পথে যায়নি, তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু গুণগত পরিবর্তন এসেছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে, প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করা হয়েছে এবং তার কারণেই ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) বাস্তবায়ন হার কিছুটা কমেছে।
তিনি বলেন, তবে বাস্তবায়নের হার কমে যাওয়ার মানে এই নয় যে গুণমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ সঠিক খাতে ও স্থানে ব্যয় হচ্ছে কি না, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, গত কয়েক মাসে কিছু গুণগত পরিবর্তন এসেছে। যাচাই-বাছাইয়ের কাজ এখন অনেক ভালোভাবে করা হচ্ছে এবং আমরা পরিকল্পনা প্রক্রিয়ার ভেতরে কিছু সংস্কারের সুযোগ দেখছি।তিনি বলেন, ধারাবাহিক রাজনৈতিক সরকার থাকলে এটি করতে পারবে এবং জনব্যয় ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, যে ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা পড়েছিলাম, সেটা আর নেই। অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, যদিও বিনিয়োগ বাড়ানো বা আরও বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, যখন এই সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন থেকে বাস্তবায়ন, তদারকি ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) আরও বেশি সক্রিয় হয়েছে। আগে কেবল শেষ হওয়া প্রকল্পগুলো মূল্যায়ন করা হতো, এখন আইএমইডি চলমান প্রকল্পগুলোও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে পরিদর্শন করছে। তিনি বলেন, পরিদর্শনের সময় পাওয়া গরমিল বা বিচ্যুতিগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে জানানো হচ্ছে। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তও করছে। এর আগে এমন কোনো নজরদারি ছিল না। তিনি জানান, যে কোনো প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ পেলে আইএমইডি মাঠে গিয়ে তা তদন্ত করছে এবং দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা করছে।
তিনি বলেন, সরকার এরইমধ্যে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) সংশোধন করেছে এবং উপদেষ্টা পরিষদ এটি অনুমোদন করেছে। চূড়ান্ত নিয়মণ্ডকানুন তৈরি হয়ে গেলে, আমরা এটি বাস্তবায়ন করব, বলেন তিনি। তিনি বলেন, সংশোধিত পিপিআর (সরকারি ক্রয় বিধিমালা)-এর আওতায় সব ক্রয়কারী সংস্থা শতভাগ ই-টেন্ডারিংয়ে যেতে বাধ্য হবে, এ সিদ্ধান্ত এরইমধ্যে নেওয়া হয়েছে।
ড. মাহমুদ বলেন, বর্তমানে ই-টেন্ডারিংয়ের অগ্রগতি ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে এবং সব ক্রয়কারী সংস্থায় শতভাগ ই-টেন্ডারিং নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, সংশোধিত আইন কার্যকর হলে তখন শতভাগ টেন্ডার ই-টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমেই আহ্বান করা বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। তিনি জানান, সংশোধিত পিপিআরের আওতায় টেন্ডার মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, অতীতে দেখা গেছে যে, নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে বারবার টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল, তবে নতুন এই ব্যবস্থায় সে ধরনের অনুশীলনের অবসান ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তিনি জানান, পুরোপুরি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আরও তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা আরও বলেন, আগে সরকারের ক্রয় কমিটি কোনো প্রকল্প পরিকল্পনা অনুমোদনের পর তা বিবেচনায় নিত, কিন্তু এখন থেকে একনেক অনুমোদিত প্রকল্প বা ক্রয় কমিটির অনুমোদিত কাজগুলো আর মনিটরিংয়ের আওতার বাইরে থাকবে না। তিনি বলেন, এটিও আইএমইডিকে (বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ) আরও সক্রিয় করার একটি অংশ।
তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নের যেকোনো সময়েই কোনো চলমান প্রকল্প মনিটরিংয়ের আওতায় আসতে পারে এবং এর অর্থ এই নয় যে, প্রকল্প পরিচালকরা মূল প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়েও নিয়মিত অর্থায়ন পেতে থাকবেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কিছু প্রকল্পে মূল ডিপিপি থেকে বিচ্যুতি পেয়েছে এবং সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, প্রকল্প প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় এখনও অনেক দুর্বলতা রয়েছে এবং তা রাতারাতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আগে বহু বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই গ্রহণ করা হতো, যার ফলে অনেক শর্ত সরকারপক্ষে অনুকূল ছিল না। বড় আকারের কিছু প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে, যেমন মেট্রো রেল বা বিআরটি প্রকল্প কিংবা চলমান যেসব প্রকল্পে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেসবের ক্ষেত্রে সরকার সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করছে।
পায়রা বন্দরের মতো প্রকল্পের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেসব ঋণ চুক্তিতে মূল্যায়ন অতিরিক্ত ছিল, সেখানে সরকার চুক্তিগুলো পুনরায় পর্যালোচনা ও আলোচনার চেষ্টা করছে। তিনি যোগ করেন, নতুন ঋণচুক্তিতে যাওয়ার আগে আমরা খসড়া চুক্তিগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করছি যাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো যায়।
তিনি বলেন, ‘প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়নের বিভিন্ন স্তরে ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়গুলো সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নিচ্ছে যাতে প্রক্রিয়াগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।’ তিনি আরও জানান, প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনায় সংশোধনী আনা হবে। নিয়মিতভাবে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় ও সময় অতিরিক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী ড. মাহমুদ বলেন, বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন অধিকাংশ প্রকল্পই আগের সরকারের আমলে গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-তে অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই চলমান প্রকল্প।
তিনি আরও বলেন, তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এসব চলমান প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করে যতটা সম্ভব অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কাটা যায়। কারণ, অনেক প্রকল্পই অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রহণ করা হয়েছিল। ব্যয় কমিয়ে হলেও চলমান প্রকল্পগুলো শেষ করাই আমাদের অগ্রাধিকার।
ড. মাহমুদ জানান, সরকার এরইমধ্যে কিছু প্রকল্প তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে যেখানে ব্যয় ছিল খুবই সামান্য এবং যেগুলো অপ্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে যেসব প্রকল্পে উল্লেখযোগ্য ব্যয় হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের মধ্য দিয়ে গেছে, সেগুলো সম্পন্ন করতে আমরা আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, বলেন তিনি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দেশীয় অর্থনীতির ‘লাইফলাইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ড. মাহমুদ বলেন, পরিষেবা খাত, কৃষি খাত এবং তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাণবন্ত অংশ।