
বায়ুদূষণের কারণে অসুস্থতা নিয়ে বাড়ছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম। সরকারের পক্ষ্যে থেকে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় প্রতিদিন মানুষ নিঃশ্বাসে টানছেন বিষ। বিশ্বের ৪০ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর জন্য দায়ীও এই বায়ুদূষণ। নতুন প্রজন্মকে সুস্থ রাখতে হলে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করছেন বিশেজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা জানায়, বায়ুদূষণ যেন ঢাকার একটি স্থায়ী সমস্যার নাম। চলতি বছরের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। দেশের অন্য শহরে একই সমস্যা দেখা গিয়েছে। বাসা থেকে বেরোলেই এ বায়ুদূষণ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারেন নগরবাসীরা। ধুলায় আচ্ছন্ন শহরগুলো যেন কুয়াশা মতো ঢেকে থাকে সারাক্ষণ। জানা জায়, বায়ুদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। গত বছর শুধু রাজধানীর ছয়টি স্কুলের শিশুদের ফুসফুসের কার্যকারিতার ওপর গবেষণা চালান হয়।
গবেষকরা বলছেন, ২৫ শতাংশ শিশুর ফুসফুস পূর্ণমাত্রায় কাজ করছে না এবং এদের বেশিরভাগেরই বয়স নয় থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। বায়ুদূষণের ফলেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান গবেষকরা।
জানা যায়, ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণজনিত সমস্যায় জর্জরিত। এর বায়ুর গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়। ইউনিসেফের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) থেকে প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদন বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী বাতাসের মানের উদ্বেগজনক অবস্থা তুলে ধরেছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
স্টেট অব গ্লোবাল এয়ারের (এসওজিএ) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়াসহ পূর্ব-পশ্চিম, মধ্য এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকার দেশগুলোতে বায়ুদূষণজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। শুধু ২০২১ সালেই বাংলাদেশে ২ লাখ ৩৫ হাজারের বেশি মৃত্যুর কারণ ছিল এই বায়ুদূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
রিপোর্টে আরও উঠে এসেছে যে, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা বায়ুদূষণজনিত রোগের বেশি শিকার হয়ে থাকে; এর প্রভাবে অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ, কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ, হাঁপানি ও ফুসফুসের রোগসহ বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার দেখা দেয়।
বাংলাদেশে সহ বেশ কয়েকটি দেশে, লোয়ার-রেসপাইরেটরি-ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণে পাঁচ বছরের কমবয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয়, তার ৪০ শতাংশের জন্যই দায়ী বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ১৯ বছরে হাজারেরও বেশি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে ব্যাপক হারে ওজোন গ্যাসের উপস্থিতি রয়েছে যা বায়ু দূষণজনিত রোগের অন্যতম কারণ। বিশ্বব্যাপী ওজোন-সম্পর্কিত ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিসঅর্ডার (সিওপিডি) জনিত মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক (৫০%) ঘটেছে ভারতে (২৩৭,০০০ মৃত্যু), চীনে (১২৫,৬০০ মৃত্যু) এবং বাংলাদেশে (১৫,০০০ মৃত্যু)।
বিশেজ্ঞরা জানায়, বায়ুদূষণের ফলে শিশুদেরই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেখা যায়; বায়ুদূষণের ক্ষতিকর এই প্রভাব, শিশু মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই শুরু হয়ে সারাজীবনের জন্য স্থায়ী হতে পারে। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা তাদের শরীরের ওজনের অনুপাতে বেশি বাতাস শ্বাস নেওয়ার সময় গ্রহণ করে; দূষিত বায়ুর সঙ্গে তারা দূষিত সব উপাদানও গ্রহণ করে থাকে; যার মারাত্মক প্রভাব পরে তাদের বিকাশমান ফুসফুস, শরীর ও মস্তিষ্কের উপর।
বায়ুদূষণজনিত এই রোগগুলোর প্রভাব ও প্রাদুর্ভাব কিন্তু বিশ্বব্যাপী সমান নয়। উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বজুড়ে মানুষের ইসকেমিক হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পেছনে বায়ুদূষণের অবদান গড়ে ২৮ শতাংশ হলেও ফিনল্যান্ড, নরেওয়ে, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এর হার ১০ শতাংশের; অন্যদিকে পূর্ব, পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর হার (যেমন নাইজেরিয়া, কেনিয়া, রুয়ান্ডা ও বাংলাদেশ) ৪০ শতাংশের বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অনিষ্টকর পদার্থের সমাবেশ যখন মানুষ ও তার পরিবেশের ক্ষতি করে সেই অবস্থাকে বায়ুদূষণ বলে। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বায়ু বা বাতাস। অন্যান্য যে কোনো দূষণের চেয়ে বায়ুদূষণের পরিধি এবং ব্যাপকতা সবচেয়ে বেশি। কারণ বাতাস স্বল্প সময়ে দূষিত পদার্থকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে পারে। বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় পরিবেশগত ঝুঁকিগুলোর একটি।
পুরো বিশ্বে ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষণযুক্ত বায়ুতে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৭ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে ২০১৯ সালে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার ৫০০ জন মৃত্যুবরণ করেছেন, যা ২০১৭ সালের তুলনায় প্রায় ৫০ হাজার বেশি।
শিশু চিকিৎসক রাশিদা বেগম বলেন, বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রজনন স্বাস্থ্য। বিশেষ করে গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বায়ু দূষণ বড় ধরণের প্রভাব ফেলে। তিনি বলেন, বায়ুদূষণ, সার্বিকভাবে পরিবেশ দূষণের এক ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে মানুষের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর। এতে পুরুষের শুক্রাণু তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছে, শুক্রাণুর মান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে মেয়েদের ডিম্বাণু কল্পনাতীতভাবে কমে গিয়েছে। আবার যেসব ডিম্বাণু রয়েছে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
রাশিদা বেগম বলেন, এসব দুর্বল বা নষ্ট ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর যখন নিষেক ঘটে. এতে যে ভ্রূণ তৈরি হয়, সেটা গর্ভে জায়গা করতে পারে না, আবার জায়গা করতে পারলেও বাঁচে না, গর্ভপাত হয়ে যায়। আর এই সমস্যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বর্তাতে পারে।
সূত্র জানায়, বায়ুদূষণ পরিবেশগত ও গৃহস্থালি সংক্রান্ত দুই ধরনের হতে পারে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে অকালে মৃত্যুর শতকরা ৮৯ ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের বিশেষত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে হয়ে থাকে। যেসব কারণে বায়ুদূষণ হয়,
(ক) মানবসৃষ্ট কারণ: ভূঅভ্যন্তর থেকে উত্তোলিত জ্বালানি যেমন- ডিজেল, পেট্রল, কেরোসিন তেল ইত্যাদি পোড়ানোর ফলে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কনা বায়ুদূষণ করে। যানবাহনের কালো ধোঁয়া, শিল্প-কারখানার ধোঁয়া, পরিত্যক্ত বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া বায়ুদূষণের কারণ। ইটভাটা, রান্নার কাজে নির্গত ধোয়া ও কয়লা পোড়ানো, ধূমপান, টায়ার পোড়ানোয় বায়ুদূষণ ঘটে। যুদ্ধে ও পারমাণবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণ হলে বায়ুদূষণ ঘটে। কৃষিক্ষেত্রে আগাছা, কীটনাশক, জৈব ফসফেট এবং ক্লোরিনযুক্ত হাইড্রোকার্বন বায়দূষণ ঘটায়।
(খ) প্রাকৃতিক কারণ: আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, গ্যাসক্ষেত্র বিস্ফোরণ, জৈব ও অজৈব পদার্থের স্বাভাবিক পচনে সৃষ্ট গ্যাস, দাবানল ও ধূলিঝড় বায়ুকে দূষিত করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, বায়ু দূষণের কারণে খাদ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে উদ্ভিদ নিজেও বিপদে পড়ে এবং উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীরাও বিপদে পড়ে। এছাড়াও উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়। উদ্ভিদের জৈবনিক প্রক্রিয়া ঠিক না থাকলে পৃথিবীতে খাদ্য শৃঙ্খল ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, বর্ষাকালে দেশের বায়ুদূষণ কম হয়। এছারা সারা বছর বায়ুদূষণ দেখা যায়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণকাজ চলছে। বায়ুদূষণ ঠেকাতে যেসব প্রটোকল মানার কথা কেউ মানছে না। এ বিষয়ে কঠোর হতে হবে এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। নির্মল বায়ু আইন প্রবর্তন ও পরিবেশ আদালত কার্যকর করা আবশ্যক। এছাড়া বায়ুদূষণ রোধে যে আইনগুলোর খসড়া তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত পাস করা এবং আইনের প্রয়োগ জরুরি।