
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন ঘিরে সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে নানা তৎপরতা শুরু হয়েছে। নির্বাচনে জিততে ‘ভোটের কৌশল’ ঠিক করছেন ছাত্রনেতারা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করে ক্যাম্পাসে পরিচিত পাওয়া শিক্ষার্থীরাও ভোটের মাঠে নামছেন। এ ক্ষেত্রে সব মতের শিক্ষার্থীদের ভোট টানতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘সম্মিলিত প্যানেল’ গোছানোর চেষ্টা করছে সংগঠনগুলো।
জাকসুর কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচন হবে ১১ সেপ্টেম্বর আর ১৫ সেপ্টেম্বর রাকসুর ভোটগ্রহণ। ‘শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য’ প্যানেল গঠনকেই প্রাথমিকভাবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে সংগঠনগুলো। ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখগুলোকে প্যানেলে টানতে নানাভাবে চেষ্টা করছেন ছাত্রনেতারা।
আড্ডা-আলোচনায় রাকসু-জাকসু: সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ক্যাম্পাসে নির্বাচনের আমেজ তত বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে চায়ের আড্ডায় নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনা করতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। ক্যাম্পাস চত্বরে আড্ডায় প্রাধান্য পাচ্ছে। ছাত্রসংগঠনগুলো প্যানেলে কাদের টানছে, শীর্ষ পদগুলোতে কারা নেতৃত্বে আসবে এবং কোন কোন ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে, তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ ও তর্কবিতর্ক। সন্ধ্যার পর আবাসিক হলগুলোর গেস্টরুম ও সামনের চা-দোকানগুলোতে পরিচিত শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চেষ্টা করছেন শিক্ষার্থীদের সমর্থন আদায়ের। দীর্ঘদিন পর রাকসু-জাকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসের পরিবেশ পরিবর্তনের প্রত্যাশা করছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ফারজানা তমা বলেন, ‘যে প্রত্যাশায় আমরা গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলাম, সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। আমরা আর নির্যাতন ও আধিপত্যের ক্যাম্পাস চাই না। আমরা চাই, এই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণ হক। এমন নেতৃত্ব আসুক, যারা শিক্ষার্থীদের হয়ে কাজ করবে।’
সবাইকে নিয়ে প্যানেল গড়ার চেষ্টা: শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীদের বাইরে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোটের সমীকরণ পাল্টে দিতে পারেন। ফলে নানা মতের শিক্ষার্থীদের নিয়ে সম্মিলিত শিক্ষার্থী প্যানেল গঠনের চেষ্টা করছে ছাত্রসংগঠনগুলো। বিভাগ ও অনুষদভিত্তিক কিছু পরিচিত মুখগুলোকে দলে টানতে চাইছে তারা। তা ছাড়া জেলা সমিতি, অঞ্চলভিত্তিক প্রার্থী ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী, এবারের রাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার ২৫ হাজার ১২৭ জন। যার মধ্যে ৬১ দশমিক ৬৫ শতাংশ ছাত্র এবং ৩৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছাত্রী। অন্যদিকে ১৯৯২ সালে সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন হয়েছিল। আসন্ন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে ১০ আগস্ট। সেদিনই প্রকাশ করা হয়েছে খসড়া ভোটার তালিকা ও আচরণবিধি। চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ও চূড়ান্ত আচরণবিধি প্রকাশ হবে ১৭ আগস্ট। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ ও জমাদান ১৮ ও ১৯ আগস্ট। খসড়া প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ২৫ আগস্ট। কমিশনের সদস্যসচিব জানান, যাচাই-বাছাই শেষে জাকসু নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজারের মতো হবে। সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবির ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী’ প্যানেল গঠনের চেষ্টা করছে। সেখানে সব মতের প্রতিনিধিত্ব রাখতে চায় তারা। ইতিমধ্যে প্যানেল গোছানো প্রায় শেষ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক আমজাদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব ধরনের প্রস্তুতি চলমান আছে। কেউ যেন পেশিশক্তির ব্যবহার ও প্রভাব ফেলতে না পারে, আমরা যথেষ্ট সজাগ আছি।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পর ১৯৬২ সালে রাকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর মোট ১৪টি নির্বাচন হয়েছে। সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে রাকসু নির্বাচন হয়েছিল। এরপর আর কোনো সরকারের আমলেই নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ বছরের ইতিহাসে ক্যাম্পাসে দলীয় লেজুড়বৃত্তির প্রভাব ছিল উল্লেখ করে ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর আমাদের একটি নতুন দিনের প্রত্যাশা আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ দেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। এ ক্ষেত্রে রাকসু নির্বাচন একটা মাইলফলক হতে পারে।’
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও নির্বাচন কমিশনের সদস্যসচিব এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, এখন পর্যন্ত জাকসু নির্বাচনকে ঘিরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। নিরাপত্তাজনিত বিষয়গুলোতে প্রশাসন সজাগ রয়েছে। খসড়া ভোটার তালিকা এবং খসড়া আচরণবিধি নিয়ে শিক্ষার্থীরা মতামত দিচ্ছেন। তিনি সবার সহযোগিতা চান। প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বলছেন, দলীয় মতাদর্শ নয়, ব্যক্তিগত যোগ্যতা কেমন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবেন কি না, এসব দেখে ভোট দেবেন তারা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মুবাশ্বিরা মাইশা বলেন, ‘টাকা দিয়ে ভোট কেনা বা শুধু দল, সংগঠন দেখে ভোট দেওয়ার সময় শেষ। আমরা দেখব কে কাজ করেছে, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই।’